যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে লড়ছেন রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৪ জুলাই ২০২৪, ১১:৪৪

ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ ৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার। স্থানীয় সময় সকাল ৭টা (বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা) থেকে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ শুরু হবে। চলবে রাত ১০টা পর্যন্ত।

এ নির্বাচনের মাধ্যমে ১৪ বছর পর আবারও বিরোধী দল লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসতে পারে বলে বিভিন্ন জরিপের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। তবে জরিপের ফলকে পাত্তা দিতে রাজি নন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। জয়ের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী বলে জানিয়েছেন।

প্রত্যাশিত সময়ের চেয়ে আগেই যুক্তরাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ হয় পাঁচ বছরের। গতবারে অর্থাৎ ২০১৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল কনজারভেটিভ পার্টি। নিয়মমাফিক পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত ২২ মে আচমকা আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক।

প্রায় দেড় মাসের নির্বাচনী প্রচারণা শেষে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ হবে যুক্তরাজ্যে। এ নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি, লেবার পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, গ্রিন পার্টি, রিফর্ম পার্টিসহ অন্তত ৯৮টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করছে। হাউজ অব কমন্সের ৬৫০টি আসনের বিপরীতে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনীত, স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ রেকর্ডসংখ্যক ৪ হাজার ৫১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে এবার ৯ নারীসহ ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক লড়াই করছেন, যার মধ্যে একক দল হিসেবে বিরোধী লেবার পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সর্বোচ্চ আট জন। বর্তমান এমপি রুশনারা আলি, রুপা হক, টিউলিপ সিদ্দিক, আপসানা বেগমসহ লেবার পার্টি মনোনীত প্রত্যেক প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। লেবার পার্টি সরকার গঠন করলে প্রথম বার মন্ত্রিসভায়ও স্থান পেতে পারেন কোনো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপিও।

২০১০ সাল থেকে টানা তিন বার ক্ষমতায় আছে কনজারভেটিভ পার্টি। এবার দলটির অবস্থা নড়বড়ে। আর মে মাসে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর ফুরফুরে মেজাজে থাকা আত্মবিশ্বাসী লেবার পার্টি জাতীয় নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী।

লেবার পার্টির পরিবর্তনের ডাকের সঙ্গে জনগণও যে পরিবর্তন চান, সেটির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে নির্বাচনী জনমত জরিপগুলোতে। সবশেষ জরিপের ফল অনুযায়ী ৪০ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম অবস্থানে রয়েছে লেবার পার্টি। ২১ পয়েন্টে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বর্তমান ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ভালো ফলাফল করলেও নির্বাচনী জরিপে ১৬ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে রিফর্ম ইউকে।

সার্ভেশনের পোলিং বিশ্লেষণে দেখা যায়, লেবার পার্টি ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৪৮৪টি আসন জিততে পারে, যা পার্টির সাবেক নেতা টনি ব্লেয়ারের ১৯৯৭ সালের ভূমিধস বিজয়ে ৪১৮টি আসনের চেয়ে অনেক বেশি। আর ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি পেতে পারে ৬৪টি আসন। ১৮৩৪ সালে পার্টি প্রতিষ্ঠার পর এবার সবচেয়ে কম আসনে জিততে পারে তারা।

বর্তমানে যে দুই দল সবচেয়ে বেশি ভোট পেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে, তারা হলো, ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি ও বিরোধী লেবার পার্টি। ৪৪ বছরের ঋষি সুনাক কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০২২ সালে যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তার বয়স ছিল ৪২। আধুনিক সময়ে ব্রিটেনের সবচেয়ে কম বয়সের প্রধানমন্ত্রী তিনি। শুধু তাই নয়, তার হাত ধরেই এ প্রথম বার কোনো ব্রিটিশ-ভারতীয় ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। অন্যদিকে লেবার পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন স্যার কিয়ের স্টারমার। তার বয়স ৬১ বছর। ২০২০ সালে জেরেমি করবিনের পর দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হন তিনি।

নির্বাচনে প্রধান দলগুলো জনমত নিজেদের দিকে টানতে চলমান সমস্যার সমাধানে ও সুসংহত যুক্তরাজ্য গড়ে তুলতে নির্বাচনী ইশতেহারে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনে গতকাল কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান ঋষি সুনাক এবং লেবার প্রধান স্টারমার প্রচারণা চালান। তারা দেশের অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন। দুই জনই দাবি করেন যদি তাদের প্রতিপক্ষ জয় পায়, তাহলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।

এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, লেবার পার্টি রেকর্ড ভাঙা জয় পেতে যাচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দল কনজারভেটিভ পার্টির এক মন্ত্রী। এর মাধ্যমে নির্বাচনের একদিন আগেই কার্যত পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে কনজারভেটিভ পার্টি।

কনজারভেটিভ মন্ত্রী মেল স্ট্রাইড বিবিসিকে বলেন, ‘আমি পুরোপুরি মানি, এই মুহূর্তে নির্বাচনের অর্থ হলো- লেবারের সবচেয়ে বড় ভূমিধস জয় দেখতে পাব আমরা। এখন বড় যে বিষয়টি হলো বিরোধী দল হিসেবে আমরা কি করতে পারব।’

পাঁচ বছর আগে কনজারভেটিভ পার্টির ব্রেক্সটের পক্ষে প্রচারে বিপুল সাড়া মিলেছিল। ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’ স্লোগানে ভর করে ‘হাউস অফ কমন্স’-এর ৩৬৫টিতে জিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছিলেন বরিস জনসন। কিন্তু ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সরকারি বাসভবনে আড়াই বছরের বেশি কাটাতে পারেননি তিনি। দলের অন্দরে বিদ্রোহ এবং কোভিভবিধি ভেঙে পানভোজনের আসর বসানোর অভিযোগ মাথায় নিয়ে ২০২২ সালে জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন।

এরপর লিজ ট্রাসের ৪৯ দিনের প্রধানমন্ত্রিত্ব পর্বের শেষে দলের অন্দরে ভোটাভুটির মাধ্যমে ওয়েস্টমিনিস্টারে আসীন হয়েছিলেন ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণমূর্তির জামাই সুনাক। নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে ব্রিটেনে ভোট করাতে হবে।

সুনক আগে বলেছিলেন, এ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে হবে ভোট। কিন্তু গত ২২ জুন হঠাৎই রাজা তৃতীয় চার্লসের সাথে দেখা করে তাকে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার আর্জি জানান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এরপর ৪ জুলাই ভোটের দিন ঘোষিত হয়েছিল। মোট চার হাজার ৫১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এ বারের নির্বাচনে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়, অভিবাসনসহ বিভিন্ন ইস্যু এবারের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৮ সালের পর অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে বেরোতে পারেনি যুক্তরাজ্য। কনজারভেটিভ পার্টির শাসনমালে যুক্তরাজ্যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে; বেড়েছে স্বাস্থ্য খাতেও। এছাড়া নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও বাড়েনি মানুষের আয়।

ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই গণনা শুরু হবে। নিয়ম অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া দলকে সরকার গঠন ও দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আহ্বান জানাবেন যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লস।

দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া দল পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী দল হবে। আর দলটির নেতা প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা হবেন। নির্বাচনে যদি কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন না পায়, তখন সেটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হবে। এ অবস্থায় তুলনামূলক সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া দলটি অন্য দলের সঙ্গে জোট সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অথবা সংখ্যালঘু সরকার হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে পার্লামেন্টে কোনো আইন পাস করানোর জন্য অন্যান্য দলের ভোটের ওপর নির্ভর করতে হবে তাদের।

৯ জুলাই নতুন পার্লামেন্ট সদস্যদের শপথ গ্রহণ ও স্পিকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৭ জুলাই রাজা তৃতীয় চার্লসের উদ্বোধনী বক্তব্যের মাধ্যমে নতুন সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে।

 



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top