চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহি গুড় দেশের সকল প্রান্তে

চুয়াডাঙ্গা থেকে | প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ১৭:৩৮

চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহি গুড় দেশের সকল প্রান্তে

চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহি খেজুরের গুড় দেশর বিভিন্ন প্রন্তে। এতে করে লাভবান হচ্ছেন জেলার সাধারণ কৃষক সহ সকল পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে জেলার সরোজগঞ্জের খেজুর গুড়ের হাট জমজমাট। চাহিদা বেশি হওয়ায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত গুড় নিয়ে আসছেন এ হাটে। স্বাদে ও গন্ধে গুড় অতুলনীয় হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এই হাটে ছুটে আসছেন ব্যাপারিরা। প্রতিহাটে প্রায় কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে এই গুড় ।

জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ বাজারে বসে খেজুর গুড়ের হাট। সারি সারি সাজানো থাকে গুড়ের পাত্র(ভাঁড়)। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শতশত কৃষক, ব্যাপারি ও শ্রমিকদের উপস্থিতিতে ওই এলাকা থাকে সরগরম। এক ভাঁড় গুড় আকারভেদে বিক্রি হয় ৯শ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। ব্যাপারিরা নলেন ও ঝোলা গুড় দেখে দরদাম ঠিক করে ওজন দিয়ে ট্রাকে তুলে নিয়ে যান ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরোজগঞ্জ গুড়ের হাট থেকে প্রতিদিন ২০-২৫ ট্রাক গুড় কিনে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যাপারিরা। প্রতি হাটে প্রায় ১ কোটি টাকার বা গুড় বেচা-কেনা হয়। আর দিনের হিসেবে ২০০-২৫০ টন গুড় কিনে নিয়ে যান পাইকাররা। দেশজুড়ে চুয়াডাঙ্গার খেজুরের গুড় ও নলের পাটালির সুখ্যাতি আছেন। স্বাদে-গন্ধেও রয়েছেন অতুলনীয় ।

স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, খেজুর গুড় ও নলের পাটালি বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে বর্তমানে জমজমাট ঐতিহ্যবাহি সরোজগঞ্জ গুড়ের হাট। চুয়াডাঙ্গা-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে শীত মৌসুমে সপ্তাহে দুদিন এ গুড়ের হাট বসে।

আলমডাঙ্গা উপজেলার বলেশ্বারপুর গ্রামেরগাছি আব্দুল মালেক জানান, তার ১০০টি খেজুড় গাছ আছে। তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর যাবৎ খেজুড়গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করে ,এ হাটে বিক্রি করে আসছি। খেজুড়গাছ তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ৬২ আড়িয়া গ্রামের ফরিদুল জানান, ১২০ টি গাছ তার প্রতি মৌসুমে ৩-৪ মাস খেজুড়গাছের রস, গুড় থেকে তার সংসার ভালোভাবে চলে যাচ্ছেন।

ফরিদপুর বাগাট থেকে গুড় কিনতে আসা কাউছার জানান, গুড়ের হাট হিসেবে এই হাটের সুনাম দীর্ঘ দিনের। তাই আমরা এখান থেকে গুড় কিনে দেশের বিভিন্ন মোকামে বেচা-কেনা করে থাকি। সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়া থেকে গুড় কিনতে আসা হাসান আলী জানান, পুর্ব পুরুশের পেশা ধরে রেখেছি। এই হাটের সুনামের কারণে ব্রিটিশ আমল থেকে আমার দাদাতারপর আমার বাবা গুড় কিনে উল্লাপাড়াসহ ঢাকার কারওয়ানবাজার বেচে আসছেন। সেটাই আমি ধরে রেখেছি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজারের মত খেজুরগাছ রয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার ৯৩ হাজার ৪৫০ টি, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৩৫ হাজার ৩১০টি, দামুড়হুদা উপজেলায় ৮৩ হাজার ৩১০টি ও জীবননগর উপজেলায় ৩৬ হাজার ৫০০ টি খেজুড় গাছ আছে। প্রতিটি গাছ থেকে এক মৌসুমে অন্তত ১২ কেজি গুড় পাওয়া যায় । সে হিসেবে জেলায় তিন হাজার মেট্রিক টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। প্রতি মেট্রিকটন ৮০ থেকে ৮৫ হাজার
টাকায় বিক্রি হয়। ওই অনুযায়ী চলতি মৌসুমে ২৪ থেকে ২৮ কোটি টাকার খেজুর গুড় বেচা কেনা হবে।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় ,বিদ্যালয় মাঠে কৃষকেরা গুড়ভর্তি মাটির ভাঁড়ও বেতের তৈরি পাত্র (ধামা) করে নলেন টালি নিয়ে বসে আছেন। বাতাসে ভেসে আসছে মিষ্টি একটা গন্ধ। ক্রেতার হাতে থাকা লোহার শিক দিয়ে গুড় ও পাটালি ভেঙ্গে মুখে পুরে পরীক্ষা করছেন । দরদাম হলেই গুড়ের কলস গুলো মাঠের এক পাশে সাজানো হচ্ছে। প্রতিটি কলসের গায়ে সাংকেতিক চিহ্ন দেখা হচ্ছে, যাতে পরে খুঁজে পাওয়া যায়। ব্যাপারিদের পাশাপাশি অনেকেই নিজের পরিবার ও স্বজনদের বাড়িতে পাঠাতে গুড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১০ কেজি ওজনের প্রতিটি কলস ৮০০- ৯০০টাকা এবং ১৫-১৬ কেজি ওজনের কলস ১ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া নলেন পাটালি প্রতি কেজি ১২০ -১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতাতের দাবি, মৌসুমের শুরুর দিকে অসাধু কিছু লোক গুড় চিনি মিশিয়ে বিক্রির পায়তারা করেন। তবে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে কিছুটা বন্ধ হয়ে গেছে । তাছাড়া গুড়ের দাম কমে যাওয়ায় ভেজালমেশানো বন্ধ হয়ে গেছে। চুয়াডাঙ্গা মার্কেটিং অফিসার সহিদুল ইসলাম বলেন, এই হাটের সুনাম ধরে রাখার জন্য কৃষি বিভাগ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

যাতে এই জেলা থেকে দেশের মানুষ ভালো গুড় ও পাটালি পায়। চুয়াডাঙ্গা সরোজগঞ্জ বাজার উন্নয়র কমিটির সভাপতি শেখ আব্দুল্লাহ জানান,চুয়াডাঙ্গাসহ আশেপাশের ৫টি জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় খেজুড় গুড়ের হাট হচ্ছে চুয়াডাঙ্গা সদরের সরোজগঙ্জ। মৌসুমে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস সপ্তাহে ২ দিন সোমবারও শুক্রবার হাট বসে। হাটের প্রতিদিন ১৮০ থেকে২০০ টন খেজুড় গুড় ও পাটালি আমদানী হয়, যার বাজারমুল্য প্রায় ১ কোটি টাকার ওপরে। তিনি বলেন, ঢাকা, চট্রগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বরিশালসহ দেশের বড় বড় মোকাম থেকে ব্যাপারিরা এখানে গুড় কিনতে আসেন ।

এছাড়া এলাকার মৌসুমী ব্যবসায়ীরা গুড় কিনে সার দেশের মোকামগুলোতে পাঠায়। জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আলী হাসান বলেন, চলতি মৌসুমে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ৯৩ হাজার ৪৫০ টি, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৩৫ হাজার ৩১০টি ,দামুড়হুদা উপজেলায় ৮৩ হাজার ৭০০টি ও জীবননগর উপজেলায় ৩৬ হাজার ৫০০টি খেজুর গাছ রয়েছে । এই মৌসুমে এই গাছগুলো থেকে ১ হাজার ৫০ মেট্রিকটন, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ২৫০ মেট্রিক টন, দামুড়হুদা উপজেলায় ৯২০ মেট্রিক টন ও জীবননগর উপজেলায় ২৮০ মেট্রিকটন গুড় তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। আশা করা যায় লক্ষ্যমার্ত্রায় চেয়ে বেশি গুড় উৎপন্ন
হবে এই মৌসুমে।

তিনি আরো জানান, এখন এই জেলায় খেজুর গুড় তৈরির ভরা মৌসুম চলছে। চাষিরা গুড় ও পাটালি তৈরীতে খুবই ব্যস্ত। দামও ভাল পাচ্ছে। আর্থিকভাবে তাদের পরিবারে সচ্ছলতাও আসছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ভাল গুড় তৈরীর জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে । গুড়ের মান ও ভাল, তবে কিছু অসাধু ব্যক্তিরা গুড়ে চিনি মেশাচ্ছে। ভাল জিনিসের কদর সব সময় আছে এবং
থাকবে ।


এনএফ৭১/জেএস/২০২১




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top