সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভোলায় অবাধে চলছে জাটকা বিক্রি

ভোলা থেকে | প্রকাশিত: ২১ মার্চ ২০২১, ২০:০৪

সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভোলায় অবাধে চলছে জাটকা বিক্রি

হালি প্রতি ২০০ টাকা, ২১০, ২২০, ২৫০ টাকা। চলছে চলছে জাটকা মাছ বিক্রির ডাক। মাছঘাটে হইচই। জেলে, আড়ত মালিক, শ্রমিকের দৌড়ঝাঁপ। এক জেলে মাছ বিক্রি করে নৌকায় উঠতেই আরেক নৌকার মাঝি মাছ এনে বাক্সে ঢালছেন। যেন বর্ষার মাছঘাটে ইলিশের ভরা মৌসুম। এ দৃশ্য ভোলার দৌলতখান উপজেলার মাঝিরহাট মাছঘাটের।

এখন ইলিশের অভয়াশ্রমে মাছ ধরার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা চলছে। অথচ এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভোলায় মেঘনা নদীতে জেলেরা মাছ ধরছেন। এগুলো মাছঘাটে প্রকাশ্যে বিক্রিও হচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাছ ধরতে বাধা দেওয়ায় জেলেদের সঙ্গে তাঁর বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। এ সময় ইউএনওর নির্দেশে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক সদস্যকে পেটানো হয়।

এর প্রতিবাদে জেলেরা উপজেলা শহরে ইউএনওর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এরপর থেকে উপজেলা প্রশাসন অনেকটা নমনীয় আচরণ করায় জেলেরা প্রকাশ্যে মাছ ধরা শুরু করেছেন। তবে ইউএনও ইউপি সদস্যকে পেটানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

দৌলতখান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, জাটকা রক্ষা ও ইলিশ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মার্চ-এপ্রিল—এ দুই মাস মেঘনা নদীতে জাল ফেলা নিষেধ। দৌলতখানে মেঘনার জলসীমা প্রায় ৯০ কিলোমিটার। ইলিশের ডিম ছাড়া ও বড় হওয়ার জন্য এ জলসীমা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইলিশের অভয়াশ্রম সৃষ্টির লক্ষ্যে পর্যাপ্ত লোকবল নিয়ে এখানে কড়া নজরদারি করা উচিত। কিন্তু তাঁদের লোকবল নেই। আছে মৎস্যজীবীদের বাধা। তারপরও তাঁরা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাঝির হাটের মতো দৌলতখান উপজেলার মুন্সিরহাট, কাজিরহাট রাস্তার মাথা, সুবেদারের মোড়, পাতারখাল, হাবুরঘাট, গুপ্তগঞ্জ, স্বরাজগঞ্জ মাছঘাটে জেলেদের মাছ বিক্রি করতে দেখা গেছে। জেলেরা জানান, আগে একটু আড়ালে মাছ বিক্রি করা হতো, তবে এখন তা আর নেই।

ভোলার মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীতে মার্চ ও এপ্রিল মাসে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। স্থানীয় কয়েকজন বলেন, জাটকা সংরক্ষণ কিংবা মা ইলিশের প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা এলেই উপজেলার জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এ উপজেলার মাছের ব্যবসায়ীরাও নদীতে অভিযান চলুক, তা চান না। মাছের ব্যবসায়ী মানেই রাজনৈতিক নেতা। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং স্থানীয় সাংসদ ছাড়া সব নেতা মাছের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাই তাঁরা ১২ বছর ধরে নিষেধাজ্ঞার সময়ে নদীতে অভিযান চালাতে গেলেই সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ওপর হামলা এবং প্রশাসনের অভিযানের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।

এসব কারণে প্রশাসন নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে নীরব থাকছে। এ সুযোগে জেলেরা মাছ শিকার করছেন। তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম আজহারুল ইসলাম বলেন, দৌলতখানের জেলেরা মৎস্য বিভাগ ও প্রশাসনকে নদীতে অভিযান চালাতে বাধা দিচ্ছেন। বাধা দেওয়া সত্ত্বেও অভিযান চলছে।
নদীতে অভিযান চালাতে যান ইউএনও।

এ ঘটনায় জেলেরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে ঘেরাও করেন। নিজের জীবন বাঁচাতে জেলেদের লাঠিপেটা করার নির্দেশ দেন ইউএনও। এ ঘটনায় ইউএনওর বিরুদ্ধে আন্দোলন নেমেছেন জেলেরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নদীতে অভিযান চালাতে যান ইউএনও। এ ঘটনায় জেলেরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে ঘেরাও করেন। নিজের জীবন বাঁচাতে জেলেদের লাঠিপেটা করার নির্দেশ দেন ইউএনও। এ ঘটনায় ইউএনওর বিরুদ্ধে আন্দোলন নেমেছেন জেলেরা। তাঁরা ইউএনওকে অপসারণের দাবিতে উপজেলার সদর রোডে মানববন্ধন করেন।

জেলেরা বলছেন, অভিযানের সময় ইউএনওর নির্দেশে উপজেলার ভবানীপুর ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও মাছ ব্যবসায়ী আবদুল মতিনের হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জেলেদের পেটানো হচ্ছে। সর্বস্তরের জনতা এ অন্যায়ের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছেন। আনসার সদস্যদের পিটুনিতে আহত মাছ ব্যবসায়ী আবদুল মতিন বলেন, তাঁর আত্মীয়েরা তাঁর ভাইয়ের অসুস্থ শ্বশুর শহিদুল ইসলামকে দেখতে লক্ষ্মীপুর গিয়েছিলেন। খালি নৌকা নিয়ে ফিরে আসার সময় তাঁর ভাই মনির হোসেনকে ইউএনও অন্যায়ভাবে আটক করে নৌকার সঙ্গে বেঁধে রাখেন। ঘটনাটি জানিয়ে তিনি (মতিন) তাঁর ভাই ও নৌকাটি ছেড়ে দিতে বললে ইউএনওর নির্দেশে তাঁকে পিটিয়ে জখম করেছে পুলিশ।
আবদুল মতিন আরও বলেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও দুইবারের ইউপি সদস্য। তিনি এ অন্যায়ের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন।

আবদুল মতিনকে লাঠিপেটা করার অভিযোগের বিষয়ে ইউএনও কাওসার হোসেন বলেন, ইউপি সদস্য আবদুল মতিনের ভাই মনির হোসেন ৬-৭ জন জেলেকে নিয়ে মাঝ মেঘনা নদীতে জাল ফেলে অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় তাঁদের (উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা) দেখে কয়েকজন জেলে লাফিয়ে পালিয়ে যান। অভিযান শেষ করে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি উপজেলার পাতারখালে ফিরে আসেন।

এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে মাছ ধরার অপরাধে চার জেলেকে এক বছর করে কারাদণ্ড ও দুজনকে ছয় হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ইউএনও কাওসার হোসেন আরও বলেন, জেলেদের সাজা দেওয়ার পর ইউপি সদস্য আবদুল মতিন ও তাঁর লোকজন সন্ত্রাসী স্টাইলে তাঁর (ইউএনও) মুখের ওপর একাধিক টর্চের আলো ফেলেন এবং তাঁকে (ইউএনও) ঘিরে ধরে সাজাপ্রাপ্তদের ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেন। নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনি আনসার সদস্যদের উপস্থিত লোকজনকে সরিয়ে দিতে বলেন। আনসার সদস্যরা বাঁশি বাজিয়ে লাঠি চালালে লোকজন দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন ইউপি সদস্য পড়ে গিয়ে ব্যথা পান। অন্য কিছু নয়।

জেলা প্রশাসক তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী বলেন, দৌলতখানে ভোলা সদর থেকেই অভিযান চালানো হবে। তাঁরা নিষেধাজ্ঞা অভিযান সফল করবেনই।

এনএফ৭১/জেএস/২০২১




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top