ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে বেড়েছে সামাজিক অস্থিরতা
রাজধানীর গণপরিবহনে দিনে ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৭:৪২
রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে প্রতিদিন ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া নৈরাজ্য হচ্ছে বলে দাবি করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটি বলছে, প্রতিবাদ করলে হেনস্তা, অপমান ও হত্যার শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।
মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত 'অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চাই' শীর্ষক আলোচনা সভায় এ তথ্য জানান সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
তিনি দাবি করেন, গত ১ বছরে দুইবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয় গণপরিবহন ভাড়া। এতে অস্থির হয়ে ওঠে গণপরিবহন খাত। বর্তমানে নগরীর কোনো পরিবহনে সরকারের নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর নেই। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চলছে। এই সময়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় তর্কের জেরে গণপরিবহগুলোতে ২৫টি যাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। এতে বাস থেকে ফেলে ১৪ যাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছে ১০ জন যাত্রী। এতে গণপরিবহন ব্যবহারে যাত্রী সাধারণের মাঝে ভীতি সঞ্চার হয়।
মোজাম্মেল হক বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত ২০ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণির গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ করে।
তার দাবি, ঢাকায় বিভিন্ন শ্রেণির গণপরিবহনে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩ কোটি ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত হয়। এতে প্রতিদিন গড়ে ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকার বেশি অতিরিক্ত ভাড়ার নামে আদায় করছে বিভিন্ন শ্রেণির গণপরিবহন।
মোজাম্মেল হক বলেন, রাজধানীর ৫০০০ বাস-মিনিবাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ লাখ ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত হয়। লক্কড়-ঝক্কড় এসব সিটি সার্ভিসের শতভাগ বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এসব বাস-মিনিবাসে যাতায়াতে যাত্রীপ্রতি মাথাপিছু গড়ে ১৭ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে হয়। এতে ৫০ লাখ ট্রিপ যাত্রী দৈনিক গড়ে সাড়ে ৮ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তিনি বলেন, রাজধানীতে ১৫ হাজার বৈধ অটোরিকশার পাশাপাশি আরও ১৫ হাজার অবৈধভাবে চলাচল করে। ৩০ হাজার অটোরিকশা দৈনিক গড়ে ১২ ট্রিপ হিসেবে ৩ লাখ ৬০ হাজার ট্রিপ যাত্রী বহন করে। এসব অটোরিকশায় প্রতি ট্রিপে গড়ে ১৪৫ টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় হয়। এতে দৈনিক ৩ লাখ ৬০ হাজার ট্রিপ যাত্রীকে অটোরিকশা খাতে কেবল বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা।
১২ হাজার বৈধ হিউম্যান হলারের পাশাপাশি মেয়াদোর্ত্তীণ, লক্কড়-ঝক্কড়, স্থানীয় গ্যারেজে তৈরি আরও প্রায় ১৮ হাজার হিউম্যান হলারসহ ৪০ হাজার হিউম্যান হলার রাজধানীতে দৈনিক গড়ে ৮০ লাখ ট্রিপ যাত্রী বহন করে। প্রতি ট্রিপে যাত্রীপ্রতি গড়ে ৮ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হয়। এতে ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা কেবল হিউম্যান হলারের যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে।’
মোজাম্মেল হক চৌধুরীর দাবি, ৫ লাখ রাইডশেয়ারিং মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, ট্যাক্সিক্যাবে দৈনিক গড়ে ২ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার ট্রিপ যাত্রী বহন করছে দাবি করে তিনি বলেন, এসব যানবাহনে যাত্রীপ্রতি গড়ে ৭৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এসব যানবাহনে প্রতিদিন গড়ে ১৬২ কোটি ৩০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে।
তাদের হিসাবে দেখা যায়, রাজধানীতে বাস-মিনিবাসের চাইতে প্রায় সাড়ে চারগুণ যাত্রী রাইডশেয়ারিং মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, ট্যাক্সিক্যাবে যাতায়াত করেন।
ভাড়া নৈরাজ্য প্রতিরোধে এবারের যাত্রী অধিকার দিবসের অন্যতম দাবি
১. পরিবহন খাত আমুল সংস্কার করতে হবে। পরিবহনে চাঁদাবাজি ও অনৈতিক লেনদেন ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে হবে। নগদ লেনদেন বন্ধ করতে হবে।
২. ভাড়া নির্ধারণে মালিক সমিতি একচ্ছত্র আধিপত্য বন্ধে অভিজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ, বুয়েটের কারিগরি জ্ঞান সমৃদ্ধ লোকজন নিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে বাসভাড়া নির্ধারণ কমিটি পূনর্গঠন করতে হবে।
৩. ব্যয় বিশ্লেষণের নামে মালিক সমিতির প্রেসক্রিপশনকে সঠিক ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা যাবে না। ভাড়া নির্ধারণে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির তালিকা মাঠ পর্যায়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও ক্যাবের প্রতিনিধি নিয়ে যাচাই বাচাই করে চূড়ান্ত করে ভাড়া নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৪. বাস ভাড়ার তালিকা সংস্কার করতে হবে। যাত্রীসাধারণ শিক্ষিত, অশিক্ষিত সকলে বুঝে, এমন ভাড়ার তালিকা বড় হরফে ডিজিটাল ব্যানারে বাসের ভিতর সাটাঁনোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. পজ মেশিনের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে টিকিট প্রদান করে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে হবে।
৬. ওয়েবিলের নামে ইচ্ছেমত ভাড়া আদায়, সিটিং সার্ভিস, গেইটলক সার্ভিস বন্ধ করতে হবে।
৭. গণপরিবহনের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, আসন যাত্রী সাচ্ছন্দে বসার উপযোগী রাখতে হবে।
৮. গণপরিবহনের বাহ্যিক পরিবেশ উন্নত করতে হবে। সার্বক্ষণিক পাখা চালু রাখতে হবে।
৯. গণপরিবহনে যাত্রী সেবা প্রদান, যাত্রী সেবার মানোন্নয়নসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সিদ্ধাস্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যাত্রী প্রতিনিধির মতামত নিতে হবে।
১০. অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে জরিমানার ক্ষেত্রে একক মালিকানার বাসে ২০,০০০ টাকা কম্পানির ক্ষেত্রে ২,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আইনে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মাসুদ কামাল, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, অ্যাসোসিয়েশন অব বাস কম্পানিস এর সভাপতি রফিকুল হোসেন কাজল, এসএমই ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলী জামান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্ঠা ও বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী প্র. মোজাহেরুল হক, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন, যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত শাকিল, বাংলাদেশ মানবাধিকার সমিতির সভাপতি মনজুর হোসেন ঈসাসহ অনেকে।
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।