১৫ আগস্টের প্রথম শহীদ কে? প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি...

রাজিউর রাহমান | প্রকাশিত: ১৬ আগষ্ট ২০২৩, ০০:৫০

ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাংলার ইতিহাসে যে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড হয়, তার মূল টার্গেট ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রথম শহীদ হন তার বড় ছেলে শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধুর ছেলে হিসেবে শেখ কামালের পরিচয় পাওয়ার পর মেজর (বরখাস্ত) বজলুল হুদা স্টেনগান দিয়ে ব্রাশফায়ারে তাকে হত্যা করে।

বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী কুদ্দুস সিকদারের জবানবন্দি থেকে এসব জানা যায়।

সিকদার বলেন, বজলুল হুদা ও নূর চৌধুরীসহ কয়েকজন প্রথমে বাড়িতে প্রবেশ করে। বাসায় ঢুকে প্রথমেই তারা শেখ কামালকে দেখতে পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা তাকে স্টেনগান দিয়ে গুলি করে। শেখ কামাল বারান্দা থেকে অভ্যর্থনা কক্ষে পড়ে যান। সেখানে তাকে আবারও গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে খুনিরা।

বঙ্গবন্ধু ভবনের আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারী এবং হত্যা মামলার বাদী মুহিতুল ইসলামের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের মধ্যেও এ বর্ণনা রয়েছে। 

মহিতুল ইসলাম ১৯৭২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্য মহিতুল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারী কাম-অভ্যর্থনাকারী ছিলেন। ১৪ আগস্ট রাত ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত তিনি ডিউটিতে ছিলেন।

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মহিতুল বলেন, ‘ভোর সাড়ে ৪টা বাজে। চারিদিক ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চারপাশে বৈদ্যুতিক আলো ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গুলি শুরু হয়।’

কিছুক্ষণ পর গুলি থেমে যায়। হাউসকিপার আবদুল ওরফে সেলিম বঙ্গবন্ধুর জন্য ওপর থেকে পাঞ্জাবি ও চশমা নিয়ে এসেছেন, বঙ্গবন্ধু ওই পাঞ্জাবি ও চশমা পরে বারান্দায় এসে বললেন, আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এত গুলি চালানো হচ্ছে, তোমরা কী করছ। তারপর তিনি ওপরে যান।

শেখ কামাল ওপর থেকে নেমে এসে বললেন, ‘সেনাবাহিনী ও পুলিশ ভাই, আমার সঙ্গে আসুন। তখন তিন-চারজন ইউনিফর্মধারী সেনা সদস্য আসেন। ইউনিফর্ম পরা বজলুল হুদা শেখ কামালের পায়ে গুলি করে। শেখ কামাল শেখ মুজিবের ছেলে হিসেবে পরিচয় দিলে তাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়।’

মহিউদ্দিন আহমেদের ‘বাড়ি নম্বর ৩২- মার্চ ২৫ থেকে ১৫ আগস্ট’ শিরোনামের বইটিতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিষয়ে হুদা বাতেন নামের একজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাতেন জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে থাকতেন।

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর বজলুল হুদা তার বোনের বাড়িতে এসে বাতেনকে নিয়ে যান। বাতেন তার বোনের বাড়িতে রাত কাটান। বাতেনের সঙ্গে হুদা গণভবনের কাছে একটি সেনা ক্যান্টিনে নৈশভোজ করেন। সেখানে হুদা বাতেনের সঙ্গে মুজিব হত্যার কথা বলেন।

হুদার বক্তব্য অনুযায়ী তিনি মেজর নূরের নেতৃত্বে শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাড়িতে হামলা চালান। গুলির শব্দ শুনে শেখ কামাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে হুদা তাকে হত্যা করে।

নিজ বাড়িতে হামলার পর বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। শেখ কামালকে হত্যার অনুরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের টেলিফোন কথোপকথন থেকেও।

১৯৮৭ এবং ১৯৯৩ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে পৃথক সাক্ষাৎকারে শফিউল্লাহ বলেন, বাড়িতে হামলার পর বঙ্গবন্ধু তাকে ফোন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সৈন্য পাঠাতে বলেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘শফিউল্লাহ, তোমার বাহিনী আমার বাড়িতে হামলা করেছে। কামালকে হত্যা করা হতে পারে। তাড়াতাড়ি তোমার ফোর্স পাঠাও।’ লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ তার ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

শেখ কামালকে হত্যার পর মহিউদ্দিন ও তার সহযোগীরা বাড়িতে ঢুকে শেখ মুজিবকে খুঁজতে থাকে। অবশেষে সামনের বারান্দায় দেখা গেল তাকে। শেখ মুজিব হাতে পাইপ নিয়ে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে দেখে মহিউদ্দিন ভয় পেয়ে গেলেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করতে পারলেন না। তিনি শুধু বললেন, ‘স্যার, আসুন আমাদের সঙ্গে।’ সিঁড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু নামতে শুরু করে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বলেন, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? এ সময় মহিউদ্দিনকে পাশে থাকতে বলে হুদা ও নূর স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে।

ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ডান হাতে পাইপ ধরে সিঁড়িতে পড়ে যান। খুনিরা তার বুকের ডান পাশে ও পেটে গুলি করে। 

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও ঘাতকদের অভিযান শেষ হয়নি। মহিউদ্দিন, হুদা ও নূর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আজিজ পাশা ও মোসলেহউদ্দিন ল্যান্সার ও আর্টিলারি সৈন্য নিয়ে আসে। পাশা তার সঙ্গীদের নিয়ে দোতলায় যায়।

সুবেদার ওহাব জোয়ার্দার আগে থেকেই সেখানে ছিল। তারা শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও বাড়ির এক চাকরকে নিচে নিয়ে যায়। পাশা ও মোসলেহউদ্দিন স্টেনগান দিয়ে বেগম মুজিব, শেখ জামাল এবং কামাল ও জামালের স্ত্রীদের বেডরুমে গুলি করে।

পরে শেখ রাসেল মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করলে পাশা একজন হাবিলদারকে রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যেতে বলে। আর হাবিলদার রাসেলকে দোতলায় তার মায়ের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল। ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মাত্র ২৬ বছর বয়সে তাঁকেও ঘাতকেরা হত্যা করে। সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তিনিই প্রথম নিহত হন।

’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা রাখেন শেখ কামাল। তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন্ড লাভ করেন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানির এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন। শাহাদাত বরণের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষার্থী ছিলেন এবং বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

শাহীন স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ অনার্স পাস করেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী শহীদ শেখ কামাল।

তিনি ‘ছায়ানট’-এর সেতার বাদন বিভাগের ছাত্র ছিলেন; ছিলেন মঞ্চ নাটক আন্দোলনের প্রথমসারির সংগঠক। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী’। শেখ কামাল ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অভিনয় শিল্পী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

শেখ কামাল আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ খ্যাতিপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকুর সাথে তার বিয়ে হয়।

বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ২০৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু (শেখ হাসিনা) ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে।

একসময় কামাল হাসিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দু’জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা’।”

 




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top