আমার ছেলের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলে করবে, তাতে কিছু আসে যায় না
ভয় নেই, বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র হলে বাংলাদেশও স্যাংশন দেবে : নিউইয়র্কে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি...
রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৬:২৭
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভিসানীতি প্রয়োগ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে বাংলাদেশের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিষেধাজ্ঞা দিলে দেবে। বাইরের দেশ থেকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হলে বাংলাদেশের জনগণও তাদের স্যাংশন দেবে। স্থানীয় সময় শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকালে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এ হুঁশিয়ারি দেন প্রধানমন্ত্রী।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি কেবল সরকারি দল নয়—বিরোধী দল যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় হয়, তাহলে তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এতে অন্তত একটা ভালো হয়েছে- বিএনপি যেমন ২০১৩-১৪ সালে নির্বাচন ঠেকাতে অগ্নিসন্ত্রাস করেছিল আবার ২০১৮ সালে নির্বাচন ঠেকাতে তারা যেমন পুলিশ মেরেছিল, পাঁচশ ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দিয়েছিল, তিন হাজার ৮৩৫টি যানবাহন পুড়িয়েছিল, যানবাহনের যাত্রী পুড়িয়ে মেরেছিল। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশে বরং আর জ্বালাও-পোড়াও হবে না। অন্তত মানুষের জীবনগুলো বাঁচবে। কারণ অগ্নিসন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো কাজ আর জামায়াত-বিএনপি আর করতে পারবে না।
নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপি-জামায়াতের নানান কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা (বিএনপি-জামায়াত) তো পুলিশের ওপর আঘাত করে। তখন পুলিশ সেটা প্রতিরোধ করলে সেটাও ফলাও করে বড় করে প্রচার হয়। তবে এখন মিডিয়ার যুগ, মিডিয়া সব তথ্যগুলো ভালো করে দেখাক। দেখালে এবার যারা স্যাংশন দিতে চায় তারা তখন ওটাও দেখবে, একতরফা দেখবে না। শুরুটা কারা করলো সেটা আগে দেখতে হবে। তখন তারা স্যাংশন দিক। আর যদি আওয়ামী লীগকে টার্গেট করে থাকে, তাহলে আমার কিছু বলার নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, যারা (যুক্তরাষ্ট্র) এটা বলছে, তাদের নির্বাচন নিয়েও কিন্তু প্রশ্ন আছে। এখনো তাদের সেই নির্বাচনই কিন্তু কেউ মেনে নেয়নি। এরা তাদের বিরোধীপক্ষের সঙ্গে কি আচরণ করছে? আমরা তো দেখতে পাচ্ছি, এরা নিজেদের বিরোধীপক্ষের সঙ্গে কি করছে? আমরা কি সেই পর্যন্ত কিছু করেছি? করিনি। আমরা তো আমাদের বিরোধীপক্ষের সঙ্গে সেটা করিনি।
তিনি আরও বলেন, যারা স্যাংশনের (নিষেধাজ্ঞা) কথা বলছে যে, নির্বাচন বানচাল করলে তারা সেটাকে স্যাংশন দেবে। আমারও কথা হলো এই বানচাল করার চেষ্টা যেন দেশের বাইরে থেকেও না হয়। দেশের বাইরে থেকেও যদি বানচালের চেষ্টা হয় তাহলে বাংলাদেশের মানুষও স্যাংশন দিয়ে দেবে। সেটাও মাথায় রাখতে হবে। আমেরিকাও দেখতে থাকুক। কাজেই বাইরে থেকেও যেন নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা না করা হয়। কারণ আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো-এই স্লোগানটি আমারই দেয়া।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি কিন্তু কারো শক্তিতে বিশ্বাস করে ক্ষমতায় আসিনি। আমি ক্ষমতায় এসেছি জনগণের শক্তিতে। জনগণের ভোটে। আমি কাজ করছি জনগণের কল্যাণে। এখানেই আমাদের স্বার্থকতা। কাজেই কে স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দিলো, আর কে স্যাংশন দিল না, আর তাছাড়া স্যাংশন দিলেও কি আছে ? আমার ছেলে তো এখানেই (যুক্তরাষ্ট্রে) আছে। এখানেই লেখাপড়া, এখানে ব্যাবসা বাণিজ্য করেছে। এখানে বিয়েও করেছে, সন্তানরাও আছে। বাড়িঘর সবই আছে। যদি বাতিল করে তো করবে। তাতে কিছু এসে যায় না। বাংলাদেশ তো আমাদের আছেই। এতে ভয় পাওয়ানোর বা ঘাবড়ানোর কিছু নাই।
তিনি আরও বলেন, যে খালেদা জিয়া আমাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেছে। আমাকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছে। এমনকি গ্রেনেড হামলার পরে একটা আলোচনা করতে দেয়নি। একটা নিন্দা প্রস্তাবও আসতে দেয়নি। খুনিদের রাতারাতি দেশ থেকে পার করে দিয়েছিল। তারপরও সেই খালেদা জিয়া কিন্তু দুর্নীতির কারণে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়া সত্বেও সরকার প্রধানের নির্বাহী ক্ষমতাবলে আমি সাজা স্থগিত করে তাকে বাড়িতে থাকতে দিচ্ছি। নিজের মতো চিকিৎসা করাতে পারছে। অথচ, ১৯৮১ সালে আমি যখন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলাম, তখন খালেদার স্বামী জিয়াউর রহমান কিন্তু আমাকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ঢুকতেও দেয়নি। তারপরে ৭৫ এর হত্যাকাণ্ড, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বহু পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই আমি এখানে এসেছি। কাজেই জনগণ যদি ভোট দেয় তাহলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ এবং এবারের সফরের নানান কর্মকাণ্ড তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবারের অধিবেশনে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব আর্থসামাজিক, অগ্রগতি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়দানের উদারতা, জলবায়ু পরিবর্তমানের বিষয়টিতে বাংলাদেশের সুদৃঢ় নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণে বহুপাক্ষিক ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থান যেমন আরো সুদৃঢ় হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরো বিস্তৃত করবে। তিনি বলেন, সামগ্রিক বিবেচনায় এবারের অধিবেশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সফল হয়েছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী ।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৪ সালের আগে বা পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে কিভাবে দুর্নীতি হয়েছে? সেটা কেন সবাই ভূলে যায়। এখন তো সেইভাবে কোনো দূর্নীতি হচ্ছে না। আর যার বিরুদ্ধেই দূর্নীতির প্রমাণ আসছে তাকে আগেই সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তাছাড়া যদি সেরকম দুর্নীতিই হয়, তাহলে দেশ এতো উন্নত হচ্ছে কিভাবে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কিভাবে?
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ২০২১ সালে আমরা উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাই। এটাকে আমরা বাস্তবায়ন করবো ২০২৬ সালে। এখানে কোনো ম্যাজিক বলতে কিছু নেই। সুষ্ঠু পরিকল্পনা, আন্তরিকতা, কর্মনিষ্ঠা, জনগণের প্রতি ভালো, দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেম হচ্ছে একমাত্র শক্তি। আমি মনে করি সেই শক্তি দিয়েই আমরা এটা করতে পেরেছি।
সরকারপ্রধান বলেন, জনগণের ক্ষমতার বদলে যদি কেউ অন্য কোনো পন্থায় ক্ষমতায় আসতে চায়, তাহলে তাদের সাজা পেতে হবে। অবৈধভাবে ক্ষমতা নেবার কোনো সুযোগ নেই। আমরা গণতান্ত্রিক ধারা এনেছি, সেটা অব্যাহত থাকবে। কে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের হাল ধরবে সেটা ঠিক করে দেবে দেশের জনগণ ও দল আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। এ সময় গুজবে কান না দিতে প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার ছেলেও যুক্তরাষ্ট্রে আছে। সে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, বিয়ে করেছে, তার মেয়ে আছে, সম্পত্তি আছে, বাড়িঘর আছে। যদি বাতিল করে, করবে। তাতে কিছু আসে যায় না।’
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে র্যাব এবং এর সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর চলতি বছরের ২৭ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন করে ভিসা নীতি ঘোষণা দেয় দেশটি। এর প্রায় পাঁচ মাস পর শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার এক বিবৃতিতে জানান, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিবৃতিতে বলা হয়, নিষেধাজ্ঞার আওতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।
এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু গণমাধ্যমকে বলেন, ভিসা নিষেধাজ্ঞা যাদের দেওয়া হবে, তাদের নাম প্রকাশ করা হবে না। এটি মার্কিন আইন অনুযায়ী গোপনীয় তথ্য। তিনি বলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ ভালোভাবে পর্যালোচনা করার পরই ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই ভীসা নীতি শুধুমাত্র নির্বাচনের দিনের জন্য নয়, বরং সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্য প্রযোজ্য।
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।