দ্বাদশ সংসদের যাত্রা শুরু আজ, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ৩০ জানুয়ারী ২০২৪, ১৬:৪৪

ছবি: সংগৃহীত

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হচ্ছে আজ ৩০ জানুয়ারি। বেলা ৩টায় বসছে এই সংসদের প্রথম অধিবেশন। আজ প্রথমে নির্বাচন করা হবে জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার। যদিও আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল স্পিকার পদে শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার পদে শামসুল হক টুকুকে মনোনীত করেছে। তাই তাঁরাই নির্বাচিত হবেন। প্রথম অধিবেশন সরাসরি দেখার জন্য বিদেশি কূটনীতিকসহ বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে সংসদ সচিবালয়।

প্রথম দিনের কার্যসূচিতে পাঁচটি কাজের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো স্পিকার নির্বাচন, ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়ন, শোক প্রস্তাব ও রাষ্ট্রপতির ভাষণ। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পরই প্রথম দিনের বৈঠক মুলতবি করা হবে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিনের এটাই হবে সংসদে প্রথম ভাষণ। মন্ত্রিসভার সোমবারের বৈঠকে রাষ্ট্রপতির ভাষণের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ভাষণই রাষ্ট্রপতি সংসদে পাঠ করেন। প্রথম দিনের বৈঠক মুলতবির পর পরবর্তী দিনের বৈঠকে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব আনা হবে। এরপর থেকে ওই প্রস্তাবের ওপর সংসদ সদস্যরা আলোচনা করবেন। আগামী ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রথম অধিবেশন চলার কথা রয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ নেতা ও দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দ্বাদশ সংসদের সংসদ উপনেতার দায়িত্ব পালন করবেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জি এম কাদের) বিরোধী দলের নেতা ও দলের কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে বিরোধীদলীয় উপনেতার স্বীকৃতি দিয়েছেন স্পিকার।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের নেতা শেখ হাসিনা এই সংসদে পঞ্চমবারের মতো সংসদ নেতার দায়িত্ব পালন করবেন। গত ১০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন একাদশ সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরীকে দ্বাদশের চিফ হুইপ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া ইকবালুর রহিম (দিনাজপুর-৩), আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন (জয়পুরহাট-২), নজরুল ইসলাম বাবু (নারায়ণগঞ্জ- ২), সাইমুম সরওয়ার কমল (কক্সবাজার-৩) এবং মাশরাফী বিন মোর্ত্তজাকে (নড়াইল-২) হুইপ নিয়োগ দিয়েছেন।

সংসদে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ নিয়োগের আইনত কোনো বিধান না থাকলেও অতীতের রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তার মহাসচিব মজিবুল হককে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ ও দলের সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদকে বিরোধী দলীয় হুইপ মনোনীত করেছে।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র পাঁচটি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে নতুন এই সংসদে। এবারের নির্বাচনে ২৭টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। আবার, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চার বারের মতো সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগেরই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ রাজনৈতিক মিত্র সংসদে প্রতিনিধি থাকা অবশিষ্ট চারটি দল।

২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত ‘নৌকা’ প্রতীকের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন ২২৩টিতে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৬২টি আসনে। ‘লাঙ্গল’ প্রতীকে জাতীয় পার্টি (জাপা) পেয়েছে ১১টি।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) রেজাউল করিম তানসেন এবারও এমপি হয়েছেন। এর বাইরে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রথম বারের মতো এমপি হয়েছেন নিজ দলীয় প্রতীক ‘হাতঘড়ি’ মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

নওগাঁ-২ আসন ছাড়া ২৯৯টি আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবেই পেয়েছে ২২৩টি। আর বিজয়ী স্বতন্ত্র ৬২ জনের মধ্যেও ৫৭ জনই আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা। সেই হিসাবে, ২৯৯ জনের মধ্যে ২৮০ জনই মূলত ‘আওয়ামী লীগ দলীয়’ সংসদ সদস্য। দল, দলীয়-স্বতন্ত্র ও জোট মিলিয়ে দ্বাদশ সংসদে কার্যত আওয়ামী লীগেরই সংসদ সদস্য ৯৪ দশমিক ৩০ শতাংশ।

আওয়ামী লীগের নেতাদের বাইরে বিজয়ী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদের রেজাউল করিম তানসেন ১৪ দলের শরিক। তারা দুই জনই ‘নৌকা’ প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। এবার জাপাকে ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে জাপা ১১টি আসনে জয়ী হয়েছে।

তবে, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিনে (গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর) জাপার জন্য ২৫টি আসনে ছাড় দেওয়ার বিষয় অবহিত করে আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) যে চিঠি দিয়েছিল, সেটিতে ‘জোট’ কথাটি উল্লেখ ছিল।

২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন-সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছে জাপা। সবমিলিয়ে বলা যায়, দ্বাদশ সংসদের ২৯৪ জন সদস্যই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অংশীদার বা রাজনৈতিক মিত্র। একাদশের মতো দ্বাদশ সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে থাকছে জাপা।

সংসদনেতার নির্দেশ ও স্পিকারের পরামর্শ অনুযায়ী চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী আসন বিন্যাস চূড়ান্ত করেছেন। আসন বিন্যাসে একাধিকবার নির্বাচিত, রাজনৈতিক দলের অবস্থান, ভোটের ব্যবধান, জনপ্রিয়তাসহ কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বারবার নির্বাচিতদের তুলনামূলক সামনের দিকে আসন দেওয়া হলেও প্রথমবার নির্বাচিত হয়েও সামনের সারিতে আসন পেয়েছেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম।

দ্বাদশ সংসদে নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে বেশি নবমবারের মতো সংসদ সদস্য হওয়ার রেকর্ড গড়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম।

আর আটবার সংসদ সদস্য হয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান খান, সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান।

এ ছাড়া বর্তমান কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, মো. দবিরুল ইসলাম, মির্জা আজম ও বীর বাহাদুর উশৈ সিং সাতবার নির্বাচিত হয়েছেন। তারা সবাই সামনের সারিতে আসন পেয়েছেন।

গত রোববার স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সরকারি বাসভবন গণভবনে আমন্ত্রণ জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে প্রধানমন্ত্রী সংসদকে কার্যকর করতে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্ররা সংরক্ষিত নারী আসনের সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে দেন।

এবারই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিরোধী দলের থেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের সংখ্যা প্রায় ছয়গুণ বেশি। ৬২ আসন পাওয়া স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা স্বতন্ত্র হিসেবেই সংসদে ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই সংসদকে ‘ডামি সংসদ’ আখ্যায়িত করে এই সংসদ বাতিল ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে আজ কালো পতাকা মিছিল করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।

নতুন এই সংসদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলানো, দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়ন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণসহ সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এই সংসদকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একপক্ষীয়। গত ১৭ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতিবিরোধী  সংস্থাটি বলেছে, ‘‘এবারের নির্বাচন অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। এ নির্বাচনের ফলে গণতান্ত্রিক অবনমনের অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচনি কৌশল ও অভিনবত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে বিবেচিত হবে।”

 

 

 

 

 

 




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top