আতঙ্কের নাম রাসেলস ভাইপার, বাঁচার উপায় কী?

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ২২ জুন ২০২৪, ১৫:২৫

ছবি: সংগৃহীত

ভয়ঙ্কর রাসেলস ভাইপারঃ

দেশের বিভিন্ন জেলায় ভয়ঙ্কর রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রব বেড়েছে উদ্বেগজনকহারে। রাসেল ভাইপার সাপের আক্রমণে আতঙ্কে দিন পার করছেন জনসাধারণ। দেশের চরাঞ্চল এবং নদী তীরবর্তী লোকালয়ে রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও কৃষির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক।

রাসেল ভাইপারের বাংলা নাম চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া। বাংলাদেশে অল্প যে কয়েকটি সাপ অত্যন্ত বিষধর, তার মধ্যে এটি একটি। রাসেল ভাইপার সাপের বৈজ্ঞানিক নাম ডাবোয়ইয়া রাসেলি, যা ভাইপারিডি গোত্রের একটি ভয়ঙ্কর বিষাক্ত সাপ।

বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এ সাপ বেশি দেখা যায় এবং এটি ভারতের সবচেয়ে বড় চারটি সাপের মধ্যে একটি। রাসেল ভাইপারের শরীরে ছোপ ছোপ চিহ্ন থাকে। আর অজগরের শরীরজুড়ে লম্বা রেখার মাঝে গোল গোল চিহ্ন থাকে। বিষধর হিসেবে রাসেলস ভাইপার বিশ্বে পঞ্চম স্থানে থাকলেও হিংস্রতা আর আক্রমণের দিক থেকে প্রথম অবস্থান। 

রাসেল ভাইপার চিনবেন যেভাবেঃ

তরুণ বন্যপ্রাণী গবেষক জোহরা মিলা জানান, রাসেল ভাইপার (Russell's Viper) সাপটি ‘চন্দ্রবোড়া’ নামেও পরিচিত। দেখতে মোটাসোটা তবে লেজ সরু হয়ে থাকে। মাথা ত্রিভুজাকার এবং ‘V’ আকৃতির সাদা রেখা আছে। শরীরের পৃষ্ঠতল বাদামী এবং বৃত্তাকার বা ডিম্বাকৃতির গাঢ় চিহ্নের তিনটি লম্বা সারি রয়েছে। সাপটির গায়ে ছোপ-ছোপ গোলাকার কালো দাগ থাকে।

তিনি বলেন, ‘সাপটি লম্বায় তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত হয়। মাথার তুলনায় ঘাড় বেশ সরু। এর গায়ের রং হালকা হলদে বাদামী। ফলে শুকনো ঘাস-পাতার মধ্যে নিজেকে সহজেই লুকিয়ে রাখতে পারে। সাধারণত মে-জুলাই মাসে এর প্রজননকাল। স্ত্রী সাপ ডিম দেওয়ার পরিবর্তে সাধারণত ৫-৫০টি বাচ্চা প্রসব করে।’

জোহরা মিলা বলেন, ‘সাপটি আতংকিত হলে বা হুমকি অনুভব করলে জিহ্বা বের করে প্রচণ্ড হিসহিস শব্দ করে। সাপটি সম্পর্কে যার ধারণা নেই তিনি এটিকে অজগর ভেবেই ভুল করবেন। এই প্রজাতিটি প্রাথমিকভাবে নিশাচর হিসেবে সক্রিয় অর্থাৎ সাপটি সাধারণত শিকার কিংবা খাদ্যের সন্ধানে রাতে বিচরণ করে।’

রাসেলস ভাইপারের বিষ অত্যন্ত শক্তিশালীঃ

রাসেলস ভাইপার সাপের বিষ অত্যন্ত শক্তিশালী। রাসেলস ভাইপার সাপের বিষের প্রভাবে সাধারণত তীব্র ব্যথা, রক্তপাত, এবং কখনও কখনও মৃত্যুও হতে পারে। যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা না করা হয়। বিভিন্ন গবেষণাপত্র এবং বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপারের বিষ একটি জটিল মিশ্রণ যা প্রোটিন, এনজাইম এবং অন্যান্য বায়োমলিকিউল নিয়ে গঠিত। এই বিষ অত্যন্ত বিষাক্ত এবং এটি মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করতে পারে।

রাসেলস ভাইপার সাপের বিষের উপাদান ‘এনজাইম’ টিস্যুর মাধ্যমে দ্রুত বিস্তার নিশ্চিত করে। আরেক উপাদান ‘ফসফোলিপেজ’ সেল মেমব্রেন ধ্বংস করে এবং হেমোলাইসিস সৃষ্টি করে, যা রক্ত কোষের ক্ষতি করে। অন্য উপাদান ‘প্রোটিনেজ’ দেহের প্রোটিন ভেঙে ফেলে, যা টিস্যু ধ্বংস এবং রক্ত জমাট বাধার ক্ষমতা হ্রাস করে।

এছাড়াও রাসেলস ভাইপার সাপের বিষে থাকে ‘হেমোটক্সিন’। যা রক্তের জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এটি রক্তজমাট বাঁধার ক্ষমতা নষ্ট করে এবং অভ্যন্তরীণ রক্তপাত সৃষ্টি করে কিংবা অতিরিক্ত রক্তপাতের সৃষ্টি করতে পারে। বিষে থাকা কিছু উপাদান কিডনিরও ক্ষতি করে। যা দংশনের পর থেকে সময় বাড়ার সাথে সাথে কিডনি ফেলিওরের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কিছুক্ষেত্রে স্বল্প মাত্রায় ‘নিউরোটক্সিন’ এর প্রভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির স্নায়বিক সমস্যাও তৈরি হতে পারে।

চিকিৎসকের মতে, গোখরো সাপের দংশনের গড় ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের দংশনের গড় ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার) সাপের দংশনের গড় ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সময়সীমার মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা জরুরি। সাপের কামড় বা দংশনের পরে, দ্রুত অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিলে, অ্যান্টিভেনমের অ্যান্টিবডিগুলি বিষকে নিষ্ক্রিয় করে । যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেঁচে যায় ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রাসেলস ভাইপার গোখরো-কেউটের চেয়েও বিষধর। সাপটির দংশনে রোগীরা চিকিৎসাধীন অবস্থাতেও প্রতি তিনজনে একজন মারা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে।

রাসেলস ভাইপার কামড়ালে করণীয়ঃ

এই সাপের কামড়ানো রোগীকে ‘অ্যান্টিভেনম’ দেওয়া হয়। এই অ্যান্টিভেনম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় এসেনশিয়াল ড্রাগ বা অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকাভুক্ত হলেও বাংলাদেশে তা উৎপাদন হয় না, ভারত থেকে আমদানি করা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একেক সাপের প্রকৃতি একেক রকম। তাই স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি হলে তা সবচেয়ে কার্যকর হয়। অন্য দেশ থেকে অ্যান্টিভেনম আনলে তা শতভাগ কার্যকর নাও হতে পারে।

চিকিৎসকদের মতে, রাসেল ভাইপারের কামড়ে যদি দাঁত বসে যায়, তাহলে ক্ষতস্থানের ওই জায়গাটিসহ ওপর-নিচের খানিকটা জায়গা নিয়ে হালকা করে ব্যান্ডেজ দিয়ে পেঁচিয়ে দিতে হবে। নড়াচড়া করা যাবে না।রোগীকে সাহস দিতে হবে। হাঁটা-চলাচল একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। যাতে রক্ত চলাচলটা একটু কম হয়। এভাবে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

রাসেলস ভাইপার স্বভাবগতই কিছুটা তেজীঃ

রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে সচেতনতামূলক কিছু পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ বন বিভাগ। গত ১০ বছর আগেও এই সাপটি তেমন চোখে পরত না। মূলত ২০১২ সালের পর থেকে এই সাপের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। রাসেলস ভাইপার দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় নদীর স্রোতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে।

কিছু সাপ যেমন, শঙ্খচূড় (King Cobra), খইয়া গোখরা (Binocled Cobra), কালাচ/কেউটে (Common Krait), শঙ্খিনী (Banded Krait) রাসেলস ভাইপারসহ অন্যান্য সাপ খেয়ে থাকে। বেজি, গুইসাপ, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বন বিড়াল, মেছো বিড়ালও রাসেলস ভাইপার খেয়ে থাকে। এছাড়া তিলা নাগ ঈগল (Crested Serpent Eagle), সারস (Stork), মদন টাক (Lesser Adjutant) রাসেলস ভাইপার খেতে পারে।

রাসেলস ভাইপার নিয়ে বন বিভাগের পরামর্শ:

• যথাসম্ভব সাপ এড়িয়ে চলুন, সাপ দেখলে তা ধরা বা মারার চেষ্টা করবেন না। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাহায্য নিন বা নিকটতম বন বিভাগ অফিসে খবর দিন।

• যেসব এলাকায় রাসেলস ভাইপার দেখা গিয়েছে, সেসব এলাকায় চলাচলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন।

• রাতে চলাচলের সময় অবশ্যই টর্চ লাইট ব্যবহার করুন। • সাপে কাটলে ওঝার কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। রোগীকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। দংশিত স্থানের উপরে হালকা করে বেঁধে দিন।

• রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যান। • আতঙ্কিত হবেন না, রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টি ভেনম (Anti Venom) নিকটস্থ হাসপাতালেই পাওয়া যায়।

রাসেল ভাইপার তাড়িয়ে ফসল কাটার পরামর্শঃ

রাসেল ভাইপার অত্যন্ত বিপজ্জনক সাপ। তবে এর সামনে পড়লে আতংকিত না হয়ে সাবধানতার সাথে সে স্থান থেকে সরে যাওয়াই উত্তম বলে মনে করেন জোহরা মিলা। তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে সাপটির কবল থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

তার ভাষায়, ‘মাঠে কাজ করার সময় অবশ্যই গামবুট ও জিন্সের প্যান্ট পড়তে হবে যেন বাড়তি নিরাপত্তা পাওয়া যায়। কাজ শুরুর আগে ছোট বাঁশ বা লাঠি বা অন্য কিছু দিয়ে শব্দ করতে হবে যেন, আশেপাশে রাসেল ভাইপার থাকলে তা দূরে সরে যায়। জমিতে কাজের ফাঁকেও এটি করতে হবে।’

‘নিশ্চিত না হয়ে কোনোভাবেই ঝোপঝাড়, বড় ঘাস, পুরাতন ও দীর্ঘদিন পড়ে থাকা ইট-পাথরে হাত দেবেন না’, যোগ করেন তিনি। সর্বোপরি যেসব এলাকায় এই সাপের উপদ্রব রয়েছে সেসব এলাকায় চলাফেরা ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলেও মনে করেন এই বন কর্মকর্তা।

রাসেলস ভাইপার নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জরুরি নির্দেশনাঃ

শনিবার (২২ জুন) সকাল ১০টায় সারাদেশের সিভিল সার্জন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বিভাগীয় পরিচালক, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে অনলাইন প্লাটফর্ম জুম মিটিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘রাসেল'স ভাইপার নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে আমি জনগণকে বলব আপনারা আতংকিত হবেন না। রাসেলস ভাইপারের যে এন্টিভেনম সেটা আমাদের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত মজুদ আছে। আমি পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছি কোনো অবস্থাতেই এন্টিভেনমের ঘাটতি থাকা যাবে না।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, সর্পদংশনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোগীকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। অনতিবিলম্বে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, সর্পদংশনের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা খুবই জরুরি। রোগীকে হাসপাতালে আনতে যাতে দেরি না হয় সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top