আহতের মাঝে এত ক্ষোভ কেন তৈরি হয়েছে?

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৮:৩৯

ছবি: সংগৃহীত

গতকাল বুধবার ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সামনে হঠাৎ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতরা ‘চিকিৎসার দাবিতে’ ক্ষোভ প্রকাশ করে।

এবার বাংলাদেশের অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও তাদের স্বজনরা দুপুর একটা থেকে রাত প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত, প্রায় সাড়ে ১৩ ঘণ্টা হাসপাতাল থেকে বিছানাপত্র এনে সড়কে অবস্থান করেছিলেন।

ওই রোগীদের কারও কারও পা ছিল না, কেউ কেউ তাদের চোখ হারিয়েছেন। অনেকের ক্ষত এখনও শুকায়নি। তারপরও তারা ‘সুচিকিৎসা’র দাবিতে বিক্ষোভ চালিয়ে গেছেন। বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ আবার স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগানও দিয়েছেন।

জুলাই-অগাস্ট মাসে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা নিয়ে এর আগেও কথাবার্তা হয়েছে। তার প্রেক্ষিতে আহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ করা হয়েছে। সরকার থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো যে আন্দোলনে আহত সবাইকে সুচিকিৎসা দেওয়া হবে। কিন্তু অভ্যুত্থানে আহত ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের বড় অভিযোগই হলো— চিকিৎসা হচ্ছে না।

কেন এমন অভিযোগ উঠছে? আহতের মাঝে ক্ষোভের জায়গাগুলো আসলে কী কী?

আহতদের অভিযোগ ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সংকট, আহতদের প্রধান অভিযোগ, তারা তিন মাস ধরে হাসপাতালে থাকলেও সরকার তাদের খোঁজ নেয়নি। সেইসাথে, আর্থিক সহায়তা হিসাবে যে এক লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা ছিল, তাও তারা পাননি।

হাসপাতালে ভর্তি থাকলে চিকিৎসা খরচ বাদে আনুষঙ্গিক আরও অনেক খরচ করতে হয় রোগীর পরিবারকে। অনেকেই বলেছেন, তাদের পরিবার সেই খরচের ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কেন বিদেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না, এই প্রশ্নের উত্তরও খোঁজ করেছেন তারা। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠনের তিন মাস হয়ে গেল। তারপরও আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত, আহতদের মাঝে এত ক্ষোভ বা অভিযোগ কেন?

‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’– এর সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, “ওনারা-আমরা আলাদা পক্ষ না। দুইটা এক পক্ষ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো– ওনাদের সুচিকিৎসার জন্য, বাইরে পাঠানোর জন্য যে ফান্ড প্রয়োজন; তার অভাব হবে না”।

তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

সারজিস বলেন, “সমস্যাটা হলো প্রসেসিং-এর জায়গাতে। তথ্য হালনাগাদ সংক্রান্ত কিছু জটিলতা ছিল এতদিন। কিন্তু “এখন সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মিলে সেল গঠন করা হয়েছে; যারা সবকিছু দেখবেৃঅনেকের তথ্য এমআইএসে নাই। জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করা প্রাথমিক লিস্ট এমআইএসে আছে। পরে নতুন তথ্য দেওয়া হয় নাই।”

সারজিস জানান, আহতদের অনেকে ফাউন্ডেশনের ফর্ম পূরণ করেছেন। কিন্তু তাদের তথ্য আইএমএস-এ না থাকার কারণে সেগুলো ভেরিফিকেশনের জন্য রাখা হয়েছে। গতকালের বিক্ষোভের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, “ফান্ড পায়নি, গতকাল এমন সংখ্যা ছিল ২০-৩০ জন।”

কারণ, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), সাভার সিআরপি হাসপাতাল, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে “চেক বা সরাসরি ফান্ড” দেওয়া হয়েছে।

শুরুর দিকে কিছু আহতদেরকে ৫০ হাজার এবং কিছু এক লক্ষ করে টাকা দেওয়া হয়েছিলো। এছাড়া, নিহতদের পরিবারকে পাঁচ লক্ষ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকজনকে বেশিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি জিএস হওয়ার পর আহতদেরকে এক লক্ষ করে টাকা দিতে বলেছি”।

সারজিস আলম জানান, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে ২৪ হাজারের মতো আহত আছেন। তবে গ্রামে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকের তথ্য এখানে যোগ হয়নি। সেক্ষেত্রে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে গত দুই সপ্তাহে দুই শতাধিক নিহত ও পাঁচ শতাধিক আহতদের মাঝে অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। তবে সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত কতজনকে দেওয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি।

সরকারি-বেসরকারিভাবে এর আগে অনেককে আর্থিক সহায়তা করা হলেও “কাগজে কলমে সবমিলিয়ে কতজনকে দেওয়া হয়েছে, সেটি বোঝার জন্যই কোলাবোরেশন টিম দরকার। এটির জন্যই একটি কমন প্ল্যাটফর্ম লাগবে। আহতদের ভেরিফিকেশন হলে অ্যাকশনে যাবে ফাউন্ডেশন”।

তবে যেসব আন্দোলনকারী বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার কথা বলছেন, তাদের বিষয়ে সার্জিস আলমের বক্তব্য, “কিছু ডাক্তার বলেছে, প্রয়োজন নাই তবুও অনেকে বাইরে যেতে চায়। উনারা কেন যেন ভাবছে যে চিকিৎসার ঘাটতি হচ্ছে, তাই বাইরে যাবে। তবে প্রয়োজন অনুসারে বিদেশ পাঠানো হবে।” “আহতদের জন্য বাজেট লিমিটেড না। এটা (এক লক্ষ টাকা) প্রাথমিকভাবে দেওয়া হচ্ছে, ধাপে ধাপে আরও দেওয়া হবে। আমরা তাদের জন্য মাসিক সম্মানী, পুনর্বাসন, উন্নত চিকিৎসার কথাও ভাবছি।”

স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ওপর ক্ষোভ কেন?

গতকাল বিক্ষোভকারীরা সুচিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তার দাবির কথা জানিয়েছিলেন। সেইসাথে, তারা স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগও চেয়েছেন। শুধু তারা নয়, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজেও সন্তুষ্ট নন অনেক পক্ষই।

সারজিস আলম বলেন, “স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে আমরা (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন) পুরোপুরি সন্তুষ্ট, তা না। কিন্তু এটাও বলতে পারবো না যে তিনি কোনও কাজ করছেন না।” “তবে এটা সত্যি যে যতটা দ্রুত হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না,” তিনি যোগ করেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “এতদিন হয়ে গেছে, তারা কেন ওখানে পড়ে থাকবে? কেন তাদের চিকিৎসা হবে না? যেখানে সরকার পুরো খরচ বহনের কথা বলেছে। বহুদিন পরে তাদের এই ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছে।” সূত্র: বিবিসি বাংলা



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top