‘দুঃখিত আপা, এখন সব আশা শেষ’, হাসিনার উদ্দেশে শফিকুল আলম

Nasir Uddin | প্রকাশিত: ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১৪:৫২

ফাইল ছবি

জাতিসংঘ সম্প্রতি জুলাই মাসে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের ঘটনাবলি প্রকাশ করেছে, যেখানে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণের ওপর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর পদক্ষেপের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে গেছে। যে কারণে শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে শফিকুল আলমের মন্তব্য, ‘দুঃখিত আপা, এখন সব (আশা) শেষ’। শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে এমনটাই জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

তিনি শনিবার রাতে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লেখেন, ‘গত আগস্টের শেষ দিকে যখন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সিদ্ধান্ত নেন যে, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাকে নিরপেক্ষভাবে জুলাই ও আগস্টের নৃশংসতার তদন্তের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে, তখন অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কেউ কেউ পুরনো বাংলা প্রবাদ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন: ‘খাল কেটে কুমির আনার যোগাড় হচ্ছে।’ কেউ কেউ মনে করতেন, জাতিসংঘের এই তদন্ত অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপের শামিল হবে এবং হয়তো একটি সমঝোতাপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করবে—যেমনটা কখনো কখনো আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে দেখা যায়।’

তবে অধ্যাপক ইউনূস তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত। তার বিশ্বাস ছিল, জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরই একমাত্র সংস্থা যারা এমন সত্য উদঘাটন করতে পারে। অবশ্য, বাংলাদেশে সবাই জানত জুলাই ও আগস্টে কী ঘটেছে, কারা হত্যার নির্দেশ দিয়েছে, পুলিশের ভূমিকা কী ছিল, নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও কর্মীদের কী ভূমিকা ছিল। তবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং নিরপেক্ষ সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন থাকাটা জরুরি ছিল। আর সেই সত্য যদি অপ্রিয় হয়, তাতেও আপত্তি নেই!

ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি আরো বলেন, অবশেষে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হেনেছে। তার রাজনীতিতে ফেরার সামান্য সম্ভাবনাও এখন শেষ। যদি আওয়ামী লীগ এবং তাদের সেই বিশাল কর্মীবাহিনী, যারা জুলাই-আগস্টের হত্যাযজ্ঞে জড়িত ছিল না, দলকে পুনর্জীবিত করতে চায়, তবে একমাত্র উপায় হলো— শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে প্রত্যাখ্যান করা এবং জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অন্য কোনো ব্যাখ্যার সুযোগ দেয়নি।

১৯৯০ সালে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ যখন গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন, তখন তার বয়স ছিল ৫৯ বছর। তিনি ছিলেন এক দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসক। এরশাদ পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে কারাগারে পাঠায় এবং দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করে। পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার সরকারও একই নীতি অনুসরণ করে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এরশাদের জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের দলে টেনে নেয়, ফলে এরশাদকে কিছু তরুণ ও বিশ্বস্ত নেতাদের ওপর নির্ভর করতে হয়।

তিনি লিখেছেন, ‘অধ্যাপক ইউনুস তার সিদ্ধান্তে স্থির ছিলেন। তিনি হত্যাকাণ্ড ও অরাজকতা সম্পর্কে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে, কেবল জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিসই এমন একটি সত্য অনুসন্ধান মিশন পরিচালনা করতে পারে। স্পষ্টতই, বাংলাদেশে সবাই জানত জুলাই ও আগস্টে কী হয়েছিল। কে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল! পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লিগ নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভূমিকা কী ছিল। তারপরও আমাদের কিছু সুপরিচিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সংস্থার প্রয়োজন ছিল সত্য খুঁজে বের করার জন্য। ’

প্রেস সচিবের কথায়, ‘প্রধান উপদেষ্টা কতটা দূরদর্শী এটা প্রমাণিত। জাতিসংঘের সত্য অনুসন্ধান প্রতিবেদনগুলি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে। তার রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ এখন শেষ। যদি তার দল এবং বৃহত্তরসংখ্যক আওয়ামী লীগ কর্মী যারা জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতায় জড়িত ছিল না, তারা দল পুনর্গঠন করতে চায়, তাদের একমাত্র উপায় এখন শেখ পরিবারকে নিন্দা জানানো এবং জাতির কাছে অঙ্গীকারহীন ভাবে ক্ষমা চাওয়া!’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি নিয়ে ভিন্ন ভাবনার সুযোগ নেই। সেনাপ্রধান এরশাদ ১৯৯০ সালে জনপ্রিয় প্রতিবাদের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় তার বয়স ছিল ৫৯ বছর বয়স। সন্দেহ নেই তিনি একজন দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসক ছিলেন। এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর কয়েক মাসের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে কারাগারে পাঠায় এবং তার বিরুদ্ধে একটি দুর্নীতির মামলা শুরু করে। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারও একই ধরনের নীতি অনুসরণ করেছিল। এরশাদের জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের বিএনপি এবং আওয়ামী লীগে ভিড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল, যা এরশাদকে কিছু তরুণ এবং বিশ্বস্ত মুখের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করে। তবুও, আমরা ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে জানতাম যে, এরশাদ একদিন না একদিন রাজনীতিতে ফিরে আসবেন। শেষপর্যন্ত, তার দেশের উত্তরাঞ্চলে একটি বিশাল আঞ্চলিক ভোটব্যাংক ছিল। ’

এরশাদ শেষপর্যন্ত ‘নায়কোচিত’ ভাবে রাজনীতিতে ফিরে আসেন বলে মন্তব্য শফিকুল আলমের।

তিনি লিখেছেন, ‘এরশাদ আর কখনও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হননি। তবে দুই দশক ধরে তিনি আমাদের রাজনীতিতে কিং মেকারের ভূমিকা পালন করেছেন। এরশাদের রাজনীতিতে টিকে থাকার কারণ ছিল যে, তার স্বৈরশাসনের জন্য কখনও আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দার মুখে পড়তে হয়নি। তাকে কখনও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়নি। তার শাসনামলে কয়েকটি বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। কোনো তদন্তে প্রমাণ হয়নি যে, তিনি সেই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ’

বিপরীতে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ এতটা সৌভাগ্যবান নয় বলে লেখেন প্রেস সচিব।

তিনি লিখেছেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলি তার (হাসিনা) সময়ে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলি নথিভুক্ত করেছে। তার ভোটডাকাতির ঘটনা ছিল স্পষ্ট ও নির্লজ্জ। জোরপূর্বক গুম, গণহত্যা এবং ব্যাপক গ্রেপ্তার দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। তবুও তিনি টিকে ছিলেন একটি শক্তিশালী দেশের (পড়ুন ভারত) সমর্থনের কারণে। প্রতি সময়েই যখন তার স্বৈরশাসন নিয়ে প্রতিবাদ হয় পশ্চিমা দেশগুলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে সমর্থন করেছে –কারণ তিনি সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সঠিক দলে ছিলেন। এমনকি তার ক্ষমতাচ্যুতির পরও, পুরো আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় মিডিয়া একরকম চেষ্টা করেছে প্রমাণ করতে যে জুলাইয়ের উত্থান আসলে এক ইসলামি অভ্যুত্থান ছিল এবং এই পরিস্থিতিকে আবারও সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে! জাতিসংঘের সত্য অনুসন্ধান প্রতিবেদন হাসিনার সব প্রত্যাশা ধ্বংস করে দিয়েছে!’

প্রেস সচিব সবশেষে শেখ হাসিনার উদ্দেশে লিখেছেন, দুঃখিত আপা। এখন সব (আশা) শেষ!




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top