বাংলাদেশের একটি এনজিওকে ২৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তার দাবি ট্রাম্পের, কী জানা গেল?

রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১৮:২০

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনীতি শক্তিশালী করতে একটি এনজিওকে ২৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি ঢাকায় নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে এনজিও সেক্টর, বিশেষ করে বৈদেশিক অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে এত অর্থ কারা পেয়েছে এবং কীভাবে ব্যবহার হয়েছে?

যদিও বাংলাদেশের এনজিও ব্যুরো বলছে, নিবন্ধিত ও সক্রিয় কোন এনজিওর কাছে এই অর্থ আসার কোন তথ্য তারা পায়নি। এনজিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবিকে অস্বাভাবিক মনে করেন তারা। সে কারণে তারা মনে করেন এমন বক্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউএসএআইডির উচিত কারা ওই অর্থ পেয়েছে সেটি প্রকাশ করা।

"বিষয়টি আমরা এর মধ্যেই চেক করেছি। এই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে সক্রিয় কোন এনজিওর মাধ্যমে এসেছে- এমন কোন প্রমাণ আমরা পাইনি । যুক্তরাষ্ট্র সরকার কিছু টাকা আরও কিছু প্রক্রিয়ায় পাঠায়। সেভাবে কোন অর্থ এসেছে কি না তা আমাদের জানা নেই," বিবিসি বাংলাকে বলেছেন এনজিও ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোঃ আনোয়ার হোসেন।

এর আগে চলতি মাসের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দক্ষতাবিষয়ক বিভাগ (ডিওজিই) বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের অনেক প্রকল্পের অর্থায়ন বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলো।

সংস্থাটি তখন জানিয়েছিলো যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নেয়া একটি প্রকল্পে ২৯ মিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু শুক্রবার ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি শক্তিশালী করতে ২৯ মিলিয়ন ডলার এমন এক সংস্থার কাছে গেছে, যার নাম আগে কেউ শোনেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দিক থেকে এমন অভিযোগ আসার পর বাংলাদেশের এনজিও খাতের জন্য এটি নেতিবাচক হবে কি-না বা এনজিওদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প কী বলেছেন

চলতি বছরের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই বিদেশে মার্কিন সহায়তা স্থগিত করতে নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বজুড়ে বৈদেশিক সহায়তায় পরিমাণের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সর্বোচ্চ।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক সহায়তা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশকে প্রতিবছর দেয়া সহায়তার পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। সর্বশেষ ২০২৪ সালে এই সংখ্যাটা প্রায় ৪৯০ মিলিয়ন ডলার ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার বড় অংশই আসে ইউনাইটেড স্টেটস্ এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বা ইউএসএআইডি এর মাধ্যমে।

এই সংস্থার তথ্য বলছে, এই অর্থ যেসব খাতে ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা, পরিবেশ ও জ্বালানি এবং মানবিক সহায়তা। কিন্তু ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের কারণে তিন মাসের জন্য এই ইইউএসএআইডির সব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।

এসব নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনার মধ্যেই শুক্রবার হোয়াইট হাউজে গভর্নরদের সাথে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি শক্তিশালী করতে ২৯ মিলিয়ন ডলার এমন এক সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পেয়েছে, যার নাম এর আগে কেউ শোনেনি।

"ছোট একটি সংস্থা। এখান থেকে দশ হাজার, সেখান থেকে দশ হাজার পায়। তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে ২৯ মিলিয়ন ডলার। দু'জন কাজ করে। আমি মনে করি তারা খুবই খুশী। শিগগিরই এই প্রতারণার জন্য বিজনেস সাময়িকীর প্রচ্ছদে জায়গা পাবে," বলেছেন তিনি। তবে ওই দুজন কিংবা তাদের সংস্থাটির নাম প্রকাশ করেননি তিনি।

একটি এনজিও ২৯ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে?

ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য সামাজিক ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তাহলো বাংলাদেশে এনজিও সেক্টর, বিশেষ করে বৈদেশিক অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে অর্থনৈতিক অনিয়মের অভিযোগ উঠতে পারে কি-না।

ইউএসএআইডির অর্থ নিয়ে কাজ করতো এমন সংস্থাগুলোর কোন কোনটি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যের পর যেসব প্রশ্ন উঠছে সেগুলোর জবাব তৈরিতে তারা এখন কাজ করছে।

বৈদেশিক অর্থায়নে পরিচালিত এনজিও খাত নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির। এর নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, "এটি (ট্রাম্পের দাবি) একটি অস্বাভাবিক দাবি। আমার মনে হয় ইউএসএআইডির অর্থায়ন বাতিলকে বৈধতা দিতে এখানে বাংলাদেশের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এভাবে কোন সংস্থার অর্থ নেয়ারই সুযোগ নেই"।

ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বলছেন ২৯ মিলিয়ন ডলার যদি এমন কোন সংস্থাকে যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে থাকে তাহলে সেটি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা। "কারণ ১ ডলারই হোক আর ২৯ মিলিয়ন ডলারই হোক- সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোন অর্থ ছাড় হওয়া অসম্ভব। আর এককভাবে কোন সংস্থার ২৯ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার খবরটিই অস্বাভাবিক," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তবে ইউএসএআইডির অর্থায়ন বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের সামাজিক ও সেবাসহ বিভিন্ন খাতে প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান রাজনীতি, গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে গত কয়েক বছর কাজ করছে এখন তাদের অনেকের দিকেই আঙ্গুল তুলতে শুরু করেছেন অনেকে।

বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থ 'বাংলাদেশের রেজিম চেঞ্জ বা সরকার পরিবর্তনে ব্যবহার হয়েছে কি-না' এমন প্রচারও চলছে। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান এনডিআই ও আইআরআই- এর টেকনিক্যাল এসেসমেন্ট মিশন । তখন তারা বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাজ করেছে।

এর আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তখনকার মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে কেউ বাধা সৃষ্টি করলে তার জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের ঘোষণা দিয়েছিলো।

আবার ইউএসএআইডির অর্থ নিয়ে যারা বাংলাদেশের রাজনীতি শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে কাজ করছিলো তাদের অন্যতম ছিলো ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল এবং কনসোর্টিয়াম ফর ইলেকশনস অ্যান্ড পলিটিক্যাল প্রসেস স্ট্রেন্দেনিং। তাদের অর্থায়ন বাতিল করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এছাড়া এগ্রিবিজনেস ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা প্যালাডিয়াম ইন্টারন্যাশনালেরও অর্থায়ন বাতিল হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির কাজ করে আসছিলেন তার এমজিআর কর্মসূচির মাধ্যমে। গত কয়েক বছরে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এ কর্মসূচির আওতায় এসেছেন।

"স্ট্রেংদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ ইন বাংলাদেশ (এসপিএল) কর্মসূচির সাথে আমরা কখনো কাজ করিনি। কিন্তু ট্রাম্প যা বলেছেন তা আমাদের সবার জন্যই বিব্রতকর। এখন একাডেমিক, শিক্ষামূলক, এবং তরুণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সক্ষমতাবৃদ্ধি, গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া ইত্যাদি নিয়ে আমরা যে কাজ করি তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা হবে দুঃখজনক," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। ।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউএসএইড ও ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকটোরাল সিস্টেমস (আইএফইএস)-এর সহযোগিতায় গণতন্ত্র চর্চা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও মৌলিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য 'অ্যাপ্লায়েড ডেমোক্রেসি ল্যাব' প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

এই ল্যাবের পরিচালক মি. ইসলাম বলছেন ট্রাম্পের বক্তব্য এসব খাতে সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করবে এবং এসব কর্মসূচি নিয়ে আস্থা হারানোর জায়গা তৈরি হবে। "যুক্তরাষ্ট্র বা ইউএসএআইডির উচিত পরিষ্কার করে বলা যে কারা তাদের ফান্ড নিয়েছে। ফান্ড তো কেউ জোর করে আনেনি। যে পেয়েছে নিয়ম মেনেছে বলেই পেয়েছে। সেখান কোন ত্রুটি থাকলে সেই দায় তো যুক্তরাষ্ট্রের। সবাইকে বিব্রত না করে এটি তাদেরই পরিষ্কার করা উচিত," বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

এনজিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রে কোন নিবন্ধন না থাকলে ইউএসএআইডি বা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের সরাসরি অর্থায়ন পাওয়া যায় না। আবার বাংলাদেশে কোন এনজিও বিদেশি অর্থায়ন পেলে সেটি ছাড় করাতে এনজিওব্যুরোতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত সব তথ্য জানানোর নিয়ম আছে।

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলছেন সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের টাকা বাংলাদেশে সরাসরি কেউ পায় না, বরং তাদের অর্থ আসে সেখানকারই কোন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে।

"তারা ঢাকায় অফিস নেয়। লোকাল পার্টনার ঠিক করে কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য। সে কারণে এখানকার কোন সংস্থার ২৯ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার দাবিটাই হাস্যকর। আবার বিভিন্ন কর্মসূচিতে যে টাকা তারা দেয় তার ৫০ শতাংশই আবার আমেরিকাতেই চলে যায়," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। তারপরেও কেউ এমন অর্থ পেয়েছে (ট্রাম্প যা দাবি করেছেন) কি-না সেটি কর্তৃপক্ষের তদন্ত করে দেখা উচিত বলে মনে করেন তিনি। সূত্র: বিবিসি বাংলা




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top