বিজয় দিবসে প্রত্যাশা
নব্য ফ্যাসিবাদী ভন্ডামি যেন সুবিধা করতে না পারে
রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:৫৪

আজ লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে উল্লাস করার দিন। বিশ্বমানচিত্রে এ দিনেইতো বাংলাদেশ নামে প্রিয় স্বাধীন ভূখণ্ডের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বিজয় ছিনিয়ে আনে দাপুটে বীর বাঙালি। মরণপণ করে সশস্ত্র যুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করে অর্জন করে হাজার বছরের কাঙ্খিত স্বাধীনতা। আজকের দিনটি একদিকে যেমন চিরগৌরব ও আনন্দের। তেমনি একইসঙ্গে স্বজন হারানোর বেদনায় নীল।
জাতিকে পরাধীনতার নিগড়মুক্ত করতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাংলা মায়ের সন্তানেরা। অগণিত মা-বোন তাঁদের প্রিয় সম্ভ্রম হারিয়েছেন। পাড়ি দিয়েছেন কন্টকাকীর্ণ কঠিন পথ। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যা চালায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপড়। গণহত্যার পৈশাচিকতায় মেতে ওঠে নগ্ন খেলায়।
শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। জানবাজী রেখে চলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। সেদিন তারা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন স্বাধীনতার বেদীমূলে। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে পাক হানাদার বাহিনী।
ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্তিলাভের পর পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে প্রথম স্বাধীনতার বীজ বপন হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এরপর ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন। ৬৬-এর ছয় দফা। ৬৯-এর ১১ দফা ও গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে। স্ফুলিঙ্গের রূপ নিয়ে একাত্তরে চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
কিন্তু আসলেই কী বাঙালি তার কাঙ্খিত মুক্তি অর্জন করেছে। বিজয়ের ৫৩ বছরেও তো ক্ষত শুকায় না। বাঙালির চোখের জল পড়া বন্ধ হয় না। বুকের দহন জ্বালা দমন হয় না। স্মৃতি ভোলা বাঙালি বার বার প্রতারিত হয়। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেব মিলে না, বড্ড হিমশিম খায়।
মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হোঁচট খায় বারবার। মুক্তিযোদ্ধার মনে এখনও ভর করে আফসোস। মানুষের মুক্তি আসেনি, বৈষম্যেরও অবসান হয়নি। উল্টো বৈষম্যের খতিয়ান স্পষ্ট হয়েছে নতুন ফরমেটে। প্রতিবাদ যুদ্ধে বারবার আমাদের রক্ত ঝরেছে। চেহারা বদল হয় চরিত্র বদলায় না। দেশের বড় জনগোষ্ঠী এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে।
অধরাই রয়ে গেছে কাঙ্ক্ষিত সুশাসন। শেষ হচ্ছে না শোষণ বঞ্চনার। বিভক্তির রাজনীতি গ্রাস করেছে আমাদের। শহীদের স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেছে। চামচা পুঁজিবাদ থেকেই চোরতন্ত্র শিকড় মজবুত করেছে। সীমাহীন লুটপাট অর্থনীতিকে ফোকলা করেছে। প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির সংস্কৃতি পঙ্গু করেছে জাতিকে।
স্বাধীনতার মন্ত্র পাঠ হয়, জনগণ রক্ত দেয়। স্বাধীনতার চেতনার নামে ভণ্ডামি সহ্য করতে হয়। অগণতান্ত্রিক এবং সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা সমাজে সবক্ষেত্রে। গণতন্ত্রের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, মুক্তিযুদ্ধ, নিয়ে পোস্টমর্টেম হচ্ছে। ইতিহাসের মালিকানা বদলাচ্ছে যখন তখন। আসল নকলের ভিড়ে নাকাল হচ্ছে জনগণ। ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসহীনতার রাজনীতির কবলে বিভক্ত আমরা।
লাখো শহিদের মৌন দীর্ঘশ্বাস আর আমাদের হতাশার ভবিষ্যৎ কাঁদায়। সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। উগ্র সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতা পেয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। যার বিষফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের। অনিয়মের রামরাজত্ব দূর হোক। শহর-বন্দরে শান্তির দূতাবাস ছড়াক। স্বনির্ভর অর্থনীতির বন্দোবস্ত হোক। একটি মানবিক, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হোক। বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রাধান্য পাক। শোষণ ও আগ্রাসন বন্ধ হোক।
শহীদের স্বপ্ন সাধ পূরণে জাতিকে তাই এক হতেই হবে। চোখের বদলে চোখ নিলে একদিন কানার পৃথিবী হবে। তখন নয়নে জলের বদলে রক্ত ঝড়বে। তাই নব্য ফ্যাসিবাদী ভন্ডামি যেন সুবিধা করতে না পারে। দেশটাকে ভালোবাসলে বড্ড সজাগ থাকতে হবে।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।