শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণের ইতিহাস!

রায়হান রাজীব | প্রকাশিত: ১ জুলাই ২০২৪, ১৮:০৯

ছবি: সংগৃহীত

শুরুটা প্রায় চারশ বছর আগের কথা। সম্রাট বাবরের মুঘল আমল থেকে পাকিস্তান আমল, মোট পাঁচ বার রাজধানী করা হয়েছে ঢাকাকে। আর বর্তমানে এই শহরে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষের বাস। আর এই মানুষগুলোর কারো কাছে ঢাকা ভালোবাসার শহর, কারো কাছে জাদুর শহর আবার কারো কাছে মায়ার শহর।

ঢাকার পুরোনো অংশের নাম পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকাকে ব্যাখ্যা করা যায় বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি বলে। এখানে প্রচুর গলি, বাজার থাকায় এই নামকরণ করেছিল হয়তো কেউ। তবে শুধু বাজার নয়, এখানে আছে অনেকগুলো পুর, গঞ্জ, তলা, তলী এবং বাহারি নামের এলাকা। এসব এলাকার নামকরণের পেছনে লুকিয়ে আছে রোমাঞ্চকর ঘটনা। ৪০০ বছরের ইতিহাসের খনি পুরান ঢাকার এলাকাগুলো যেন একেকটা গল্পের ঝুলি।

আজকের ঢাকার বিভিন্ন স্থান একসময় ছিল অতি মনোরম। পাখির কলকাকলি, নদীর কলতান, জীবজন্তুর অবাধ বিচরণ ছিল প্রায় প্রত্যেকটি এলাকায়। পরিবর্তনের দমকা হাওয়ায় বদলে গেছে সেসব জায়গার পরিবেশ। বদলে গেছে এমনকি সেসব স্থানের নামও।

দশকের পর দশক, ইতিহাস- ঐতিহ্যের নানা ধাপ পেরিয়ে আজকের ঢাকা। ঠিক এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যদি প্রশ্ন জাগে কেমন ছিল সেই শুরুর ঢাকা? বাহারি নামকরণই বা হলো কীভাবে? ইতিহাসের ভিড়ে কেউ কেউ স্মৃতি খুঁজে ফিরবেন। কেউ কেউ কৌতূহলী হবেন নিশ্চয়ই! পদে পদে পরিবর্তনের ছোঁয়ায় কতোটুকুই বা বদলেছে এর নামকরণ?

বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির এ শহরে আজ অগণিত বাজার আর গলির ভিড়। পুর, গঞ্জ, তলা, তলী, টোলা, টুলি বাহারি নামকরণের গল্প আমাদেরকে নিয়ে যায় শত বছরের পুরোনো ইতিহাসের দোরগোড়ায়। বিবর্তনের ধারায় দৃশ্যপট যেমন বদলেছে, তেমনি মানুষের মুখে মুখে বদলে গেছে বিভিন্ন স্থানের নামের বানান ও উচ্চারণ।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে পুরান ঢাকার স্থাপনাগুলো যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি হারাতে বসেছে তার সোনালি ইতিহাসের গল্পগুলোও। অথচ এখনো পুরান ঢাকার অলিগলি, রাস্তাঘাট, বাজার, এলাকা- সবকিছুই যেন গলা উঁচিয়ে জানান দেয় তার অতীত-জৌলুসের কথা। তাহলে আর দেরি নয়, চলুন জেনে নেওয়া যাক ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণের নেপথ্য—

ওয়ারী: পুরান ঢাকার স্থানীয় লোকদের কাছে পুরান ঢাকার রাজধানী খ্যাত ওয়ারী। ১৮৮৪ সালে ঢাকা নগরীর ম্যাজিস্ট্রেট ওয়্যারের নামানুসারে এলাকাটির নামকরণ করা হয় ওয়ারী। বর্তমানে একটু উঁচু শ্রেণির লোকদেরই বসবাস এ এলাকায়।

১৮৮৪ সালে ঢাকার বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেট মি. আয়ার এর নামানুসারে একটি সড়ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সড়ক সংলগ্ন এলাকাটিকে বৃটিশ সরকার একটি অভিজাত পল্লীতে রূপান্তরের চেষ্টা চালায় । সে সূত্রে সেখানে সরকারি কর্মচারীদের জন্য আলাদা করে জমি বরাদ্দ করে দেয়া হয়। বরাদ্দের শর্ত হিসেবে সরকার বলে দিয়েছিল বিঘাপ্রতি ছয় টাকা হারে এবং তিন বছরের মধ্যেই বাড়ি তৈরি করতে হবে। সেসময় মুসলমানদের সরকারি চাকরি নিষিদ্ধ ছিল বলে এলাকাটি হিন্দু কর্মকর্তা অধ্যুষিত হয়ে যায়। ধারণা করা হয় ওই ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলোক আয়ার এর নামানুসারে এলাকাটির নাম ওয়ারী রাখা হয়।

সিক্কাটুলি: পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক মোড় থেকে শাঁখারি বাজারের দিকে দুই মিনিট হাঁটার পরে ডান দিকে যে সরু গলিটি নয়াবাজারে গিয়ে মিশেছে সেটিই সিক্কাটুলি নামে পরিচিত। গলিটির শেষ প্রান্তে রয়েছে সিক্কাটুলি পার্ক ১৮৭৬ সালে ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হলে কিছু লোক টাকার বিনিময়ে চামড়ার ব্যাগে বাসাবাড়িতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতো। এদেরকে বলা হতো ভিস্তি বা সুক্কা। এই এলাকায় তাদের বসবাস ছিল বিধায় এলাকাটির নামকরণ করা হয় সিক্কাটুলি। এলাকাটিতে এখনো কিছু ভিস্তিদের বসবাস রয়েছে। তবে তারা এখন চামড়ার ব্যাগের পরিবর্তে চারকোনা টিনের কোলায় পানি সরবরাহ করে। গোলাম হক নামের এক ভিস্তি তার স্ত্রী সন্তানসহ এই এলাকায় বসবাস করেন। তাদের ব্যবসার বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে বলেন, ‘এহনে আধুনিক  প্রযুক্তি আবিষ্কার হইয়া গেছে, মানুষ যন্ত্র দিয়া পানি বিশুদ্ধ করে। তাই আমাগো কাজ কইমা গেছে। তাও এহনে দোকানে দোকানে পানি দেই। সিক্কাদের এই পেশা বিলুপ্তপ্রায় হলেও সিক্কাটুলি দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।

ধোলাইখাল: ছবির মতো দেখতে ছোট্ট নদী। নদীর দুপাশে সবুজে ঘেরা গাছপালা। স্বচ্ছ পানিতে পড়েছে মেঘের ছায়া। অনলাইনের বিভিন্ন সাইটে ১৮৭০ সালের ধোলাইখালের এমনই একটি ছবি ঘোরাফেরা করছে প্রতিনিয়ত।  অনেকে এ ছবি দেখে মুগ্ধ হলেও অনেকে হন স্মৃতিকাতর। তৎকালীন ঢাকার প্রধান জলপথ ও নগর রক্ষার পরিখা হিসেবে ‘দোলাইখাল’ নামের এ খালটি খনন করেছিলেন সুবাদার ইসলাম খান। কালক্রমে মানুষের মুখে মুখে নামের পরিবর্তন হয়ে ধোলাইখাল হয়ে যায়। বর্তমানে এখানে খালের পরিবর্তে আছে রাস্তা। ব্যস্ততম রাস্তার দুইপাশে অয়েছে যন্ত্রাংশ মেরামত ও তৈরির অসংখ্য ছোট ছোট দোকান।

সূত্রাপুর: ঢাকার প্রাচীন মহল্লাগুলোর মধ্যে সূত্রাপুর অন্যতম। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ এ এলাকা। প্রাচীন ঢাকায় কাঠের বাড়িঘর, নৌকায় দারু শিল্পের কাজ যারা করতো তাদেরকে বলা হতো সূত্রধর। সূত্রধরদের বসবাস ছিল বিধায় এ এলাকার নামকরণ করা হয় সূত্রাপুর।  বর্তমানে এ এলাকায় কিছু দারু শিল্পীদের বসবাস রয়েছে। অনেকে তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য থেকেই এ পেশা বেছে নিয়েছে। তবে দিন দিন অনেকে এ পেশা থেকে আগ্রহ হারাচ্ছে। দারুশিল্পী পলক সূত্রধরের বসবাস সূত্রাপুরের লোহারপুল এলাকায়। তার বাবা, ঠাকুরদারাও এ পেশায় যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে শ্রম অনুযায়ী মজুরি পাওয়া যায় না।  প্রযুক্তি ব্যবহার করে অল্প সময়েই নকশা করা যাচ্ছে। তবে অনেক শিল্পপ্রিয় মানুষ এখনো এখানে আসে কাঠের নকশাদার আসবাবপত্র তৈরি করতে।

ইসলামপুর: পুরান ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারি কাপড়ের মার্কেট ইসলামপুর। সরু রাস্তার দুপাশে সারি সারি কাপড়ের দোকান। হাজার হাজার ক্রেতাদের ভিড়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষেরই অজানা এই ঐতিহ্যবাহী ইসলামপুরের ইতিহাস। ১৬১০ সালে মুঘল সম্রাট সুবেদার ইসলাম খানের হাত ধরেই আজকের এই রাজধানী ঢাকার গোড়াপত্তন। ইসলাম খান এই এলাকায় বসবাস করতেন। তখন এই এলাকায় ঘড়ি, কাঁসা পিতল ও বই পুস্তকের রমরমা ব্যবসা ছিল। এখনো সেই ব্যবসা কিছু কিছু থাকলেও কাপড়ের জন্যই ইসলামপুর বিখ্যাত। সুবেদার ইসলাম খানের নামানুসারেই এই এলাকার নামকরণ করা হয় যদিও তার বসবাসের কোনো চিহ্ন এই এলাকায় নেই।

মাহুতটুলি: বাবুবাজার ব্রিজ থেকে বামদিকে আরমানিটোলা রোড দিয়ে সোজা উত্তর দিকে গেলেই মাহুতটুলি। ঐতিহ্যবাহী এই স্থানে একসময় হাতির মেলা হতো। হাতি কিনতো রাজা বাদশাহরা। হাতির পিঠে চড়ে রাজ্য প্রদক্ষিণ করা ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।   যারা এসব হাতির দেখাশোনা করতেন তাদেরকে বলা হতো মাহুত। মাহুতরা এই এলাকায় বসবাস করতেন বলেই এখানকার নামকরণ করা হয়েছে মাহুতটুলি।

টিকাটুলি: টিকাটুলির মোড়ে একটা হল রয়েছে  জনপ্রিয় এই ‘আইটেম’ গানের জন্য হলেও টিকাটুলির নাম সবারই জানা। কিন্তু এই স্থানের নামের ইতিহাস যে তামাক বিলাসের সঙ্গে যুক্ত তা হয়তো অধিকাংশেরই অজানা। কাঠ কয়লার গুড়ো দিয়ে মার্বেলাকৃতির ‘টিকিয়া’ নামের তামাকদ্রব্য বানানো হতো। যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বিক্রি হতো। কিন্তু  টিকিয়া কারিগররা তাদের টিকিয়া বানানোর পদ্ধতি সাধারণ মানুষদের শেখাতো না। ফলে ওই কারিগরদের মৃত্যুর পরে টিকিয়া শিল্প পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু থেকে যায় টিকিয়া কারিগরদের বসবাসের স্থান ঐতিহ্যবাহী টিকাটুলি।

ফরাশগঞ্জ: বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা ফরাসি বণিকদের স্মৃতি বিজড়িত এলাকা ফরাসগঞ্জ। ১৭৮০ সালে এ এলাকায় ব্যবসার উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি গঞ্জ স্থাপন করে ফরাসিরা।  তখন সেই গঞ্জটি ফ্রেন্সগঞ্জ বা ফরাসিগঞ্জ নামে পরিচিত ছিল। কালক্রমে মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তন হয়ে ফরাসগঞ্জ নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে মসলার আড়তের জন্য এলাকাটি সুপরিচিত।

মালিটোলা: রায় সাহেববাজার মোড় পার হয়ে পশ্চিম দিকে ইংলিশ রোড। ইংলিশ রোডের দক্ষিণ পাশেই মালিটোলা। বর্তমানে এখানে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন পার্ক। মোঘল সম্রাটরা ফুল বাগান খুব ভালোবাসতেন। তাই যেখানেই রাজত্ব করতেন সেখানেই তৈরি করতেন ফুলের বাগান। আর এসব বাগান পরিচর্যা করতে নিয়োগ দিতেন দক্ষ মালি। এই মালিরা তাদের পরিবারবর্গ নিয়ে বসবাস করতেন এই এলাকায় যার জন্য এই এলাকার নামকরণ করা হয়েছে মালিটোলা।

সদরঘাট: সদ্য জন্ম নেয়া ঢাকা শহরে যখন ট্রেন কিংবা সড়ক যোগাযোগের উদ্ভব হয়নি তখন সদরঘাটই ছিল যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম, যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র। সদরঘাট দিয়েই বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত বাণিজ্যিক মালপত্র ঢাকায় প্রবেশ করতো। এইজন্যই এর নাম দেয়া হয়েছে সদরঘাট বা ‘প্রধানঘাট’। সদরঘাট আসলে কবে নির্মিত হয়েছে তার সঠিক কোনো বর্ণনা কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় সদরঘাটের বয়স সহস্র বছর পেরিয়েছে। কালক্রমে সদরঘাট তার জৌলুশ হারাতে বসেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন উন্নত হয়েছে।

এই এলাকাগুলো ছাড়াও পুরান ঢাকায় আছে আরও অনেক এলাকা আরও অনেক ইতিহাস। এর যা কিছু বিলুপ্ত হয়েছে আর যা কিছু বাকি আছে সবই কোনো না কোনো আখ্যান তুলে ধরে।  এখানকার রাস্তায় হাঁটলে মনে হতে পারে কোনো জীবন্ত সত্ত্বা শোনাচ্ছে তার গল্প। পুরান ঢাকার জৌলুশকে আস্তাকুঁড়ে ঠেলে না দিয়ে প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে সমৃদ্ধশালী এক ঢাকার গল্প।

 

 

 

 



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top