দরকার শিরদাঁড়া সোজা করা সাংবাদিকতা
গণমাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী অপশাসন, মব জাস্টিস কাম্য নয়
রাজীব রায়হান | প্রকাশিত: ২ জানুয়ারী ২০২৫, ১৫:১১
কেবল সাংবাদিকতা নয়, নয়া দুনিয়ায় টিকতে এক্সপেরিমেন্ট জরুরি। সঙ্গে থাকতে হয় ইমাজিনেশন, নিয়ম ভাঙ্গার অদম্য সাহস। এসব অর্জনের পর যেটা জরুরি তার নাম কঠোর অনুশীলন। তবে ভিশন আর এম্বিশন যেন সততাকে সঙ্গে নিয়েই হয়। সাংবাদিক যেহেতু, সাংবাদিকতা নিয়েই দুচারটে কথা বলাই শ্রেয়। সাংবাদিকতার চিত্র অনেকে অনেক ভাবে বিশ্লেষণ করেন। সাংবাদিকদের নিয়েও বাজারেও নানা আলোচনা চলমান। পক্ষে বিপক্ষে নানান মত থাকা মন্দ নয়। সাংবাদিকতা যেমন গুরুমুখী বিদ্যা তেমনি এ পেশা মুর্খজনেরও নয়। দায়িত্ব অনেক, শত্রুপক্ষ কম নয়, নানামুখী চাপ। অনুসন্ধিৎসু মন আর পড়াশুনার গভীর আগ্রহটাই পুঁজি।
অফিস পলিটিক্সতো সব জায়গায় কমবেশি, মিডিয়াও বাইরে নয়। নানা প্রতিশ্রুতি, নসিয়ত আর বয়ান প্রতিদিনের সঙ্গী। চাকরি যাবার আতঙ্ক সাংবাদিকতায় বাধ্যতামূলক। দু একটি ব্যতিক্রম। তারপরও পেশাটি এক সময় নেশায় পরিণত হয়। পাঠকের মনস্তত্ব বুঝতে হয় গভীরভাবে। নীতির প্রশ্নে কম্প্রোমাইজ চলে না এখানে। শাশ্বত সত্যটি লিখে যেতে হয়। যারা এমনটা করেন তাদের প্রতি মানুষের বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধাবোধ। দালাল সাংবাদিকদের কথা ভিন্ন। অপসাংবাদিকতা করেই তাদের রুটিরুজি চলে। তাদের সংবাদভাষ্যে গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা। সাংবাদিকদের মান অপমান এদের জন্যই। সাংবাদিকতা এদের কাছে অকুপেশন, প্রফেশন নয়৷
আরও একটা ভয় আছে। পাঠক দর্শক হারানোর ভয়। ভিউ বাণিজ্যের উদ্ভট প্রতিযোগিতা এখন মগজে। স্বকীয়তা, আর বিশ্বাসযোগ্যতা অবলম্বন। এজন্যই জার্নালিজমের সঙ্গে প্রফেশনালিজম শক্তভাবে জড়িত। বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ব্রত- এসব কাগুজে কথা। সাংবাদিকতার রাজনীতিকরণ এদেশে মারাত্মক। এজন্যই সাংবাদিকতার বিকাশের গতি মন্থর। রয়েছে জটিল কর্পোরেট পলিসি আর সম্পাদকীয় নীতি। উপরন্তু তথ্যের সুনিপুণ বিকৃতি, তথ্য ও মতামতের মিশ্রণ, ভাষাগত ত্রুটির দারুণ মুন্সীয়ানা।
মিডিয়াকে হতে হয় স্বচ্ছ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। একাডেমিক শিক্ষার বাইরে এপেশায় গুরুর কাছে দীক্ষা নিতে হয়। গুরু পরম্পরা ও মিথস্ক্রিয়ায় ঋদ্ধ হতে হয়। আমার এপেশার শিক্ষকদের একজন নাঈমুল ইসলাম খান। বড় সাংবাদিক তৈরিতে নাঈমুল ইসলাম খানের ভূমিকা কম নয়। বাংলাদেশে নতুন ধারার সাংবাদিকতা শুরুর ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃৎ। দেশের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল সাংবাদিকদের একজন তিনি। তার প্রথাবিরোধী চিন্তা এবং কর্ম শিল্পটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। দূরদর্শী ও সৃষ্টিশীল সংবাদকর্মী, জাদরেল সম্পাদক তিনিই তৈরি করেছেন।
নাঈম ভাই সম্পর্কে বিজ্ঞজনেরা মন্তব্য করেছেন। তাদের একজন বলেছেন, সংবাদপত্রের পরিবর্তন নাঈমুল ইসলাম খানের হাত ধরেই। জনাব, সর্বজনাব, মাননীয়, মহামান্য রীতি থেকে পাঠককে মুক্তি দিয়েছেন তিনি। বাহুল্য-মেদ বর্জিত অভিনব সংবাদপত্র উপহার দিয়েছেন। ঠিক যতটুকু দরকার, করেছেন ততটুকুই পরিবেশন শিখিয়েছেন। পাঠক যেন একপলকেই পায় প্রয়োজনীয় খবর। প্রথম পাতায় তিন লাইন পড়ে বাকিটা অন্য পাতায় হাতড়াতে না হয়। তার হাত ধরেই খবরের কাগজ, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ হয়ে আজকের প্রথম আলোর বিকাশ। এরপর আমাদের সময়, আমাদের নতুন সময়, আমাদের অর্থনীতি।
পুরোদস্তুর সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খানের তীব্র সমালোচনাও আছে। পত্রিকা গড়ে সেটা বিক্রি গড়ে দেয়ার অভিযোগও আছে। তার পত্রিকা তিনি বিক্রি করবেন না রাখবেন, সেটা ভিন্ন আলোচনা। নাঈম ভাইয়ের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ, তিনি তার সহকর্মীদের বেতন দেন কম। বেতন কম না বেশি সেটার মানদণ্ড নিশ্চয়ই আছে। তবে কম দিলেও সময়মতো বেতন দেয়ার চেষ্টা জারি ছিল। কোনো সাংবাদিকের বেকার আছেন এমন খবর পেলে নাঈম ভাই দ্বিতীয়বার ভাবেন না। সম্মানের সঙ্গে চাকরি দেয়ার সাহস দেখান। ভুল করলে নিজের পত্রিকায় ক্ষমা চাওয়ার দুরন্ত সাহসও একমাত্র তার।
ভিন্নমতকে ধারণ করার, পরমতসহিষ্ণুতার শক্ত ক্ষমতা আছে নাঈম ভাইর। তার কঠোর সমালোচনা তার পত্রিকায়ই ছাপা হওয়া সম্ভব। পিতার একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে তার পত্রিকাতেই রিপোর্ট প্রকাশ সম্ভব। টকশোতে তিনি কখনোই জানতে চান না, তার সাথে কে আছে। তাৎক্ষণিক যুক্তির অসাধারণ ক্ষমতা আছে নাঈমুল ইসলাম খানের। তিনি যেকোনো পক্ষে যুক্তি দিতে পারেন অনায়াসে। দুই পক্ষের যুক্তিই অকাট্য মনে হবে। টকশোতে প্রতিপক্ষের আক্রমণ যুক্তি দিয়ে সামাল দেন সহজভাবেই। সাংবাদিকতায় তার অন্তহীন গবেষণা সমৃদ্ধ করেছে দেশীয় সাংবাদিকতাকে। তরুণ প্রজন্মকে বুদ্ধিবৃত্তিক পথে উদ্বুদ্ধকরণের ফসল আমরা। ওয়ান ম্যান রেভুলেশন ঘটিয়েছিলেন নাঈম ভাই।
প্রিয় সম্পাদক নাঈম ভাইর সমালোচনা বন্দনা শেষ। এবার প্রাণের পত্রিকা আমাদের নতুন সময় সম্পর্কে দুচারটে কথা। কতশত স্বপ্নবান তরুণের সমাবেশ আমাদের নতুন সময়ে। তারা এখানে কাজ করেন, সাংবাদিকতা শেখেন। তাদের রুটিরুজির বন্দোবস্ত এখান থেকেই হয়। ভিন্নমত হলেই গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ এদেশে নতুন নয়। এবার তার শিকার হলো আমাদের নতুন সময়। কপাল পুড়লো শত সাংবাদিকের, তাদের পরিবারের। ছিটকে পড়া সাংবাদিকরা দিগ্বিদিক ছুটে চলেছেন জীবিকার খোঁজে।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদপত্র অফিসে হামলা, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা এবং সাংবাদিকদের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল শঙ্কার কারণ। প্রতিদিনই শঙ্কা, আশঙ্কা বা প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকতা সবসময় চ্যালেঞ্জিং, এটাই এই পেশার সৌন্দর্য৷ এই চ্যালেঞ্জে জেতার জন্য দরকার শিরদাঁড়া সোজা করা সাংবাদিকতা৷ আপোস বা চেপে যাওয়া সাংবাদিকতায় গণমাধ্যমের কোন পরিবর্তন হয় না৷ ফ্যাসিস্ট রেজিমের সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে, আইন তাদের বিচার করবে। কিন্তু গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা সমর্থন করা যায় না। এমন হলে শাসকের প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাসে বড় সংকট তৈরি হবে।
গণমাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী অপশাসন, মব জাস্টিস কাম্য নয়। স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া স্বাধীনতা অর্থবহ হয় না। যদি আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ চাই তাহলে কথা বলার জায়গা সংকুচিত করা যাবে না। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ এই সংবাদ মাধ্যম। প্রতিশোধ কখনো মঙ্গল বয়ে আনে না। মতের বিরুদ্ধে মত, যুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তির লড়াই কাম্য। মত প্রকাশের পথ যখন সংকুচিত হয়, তখন মনে পড়ে ফ্রাঙ্কো ম্যারিক আরোয়েট ভলতেয়ারের কথা। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছেন, তোমার মতের সঙ্গে আমি হয়তো একমত নাও হতে পারি। কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে যাব। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভলতেয়ার সূত্রটি মনে রাখুন। না হলে রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়বে।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।